করোনা কেড়েছে রোজার আনন্দ
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ মে ২০২০, ৭:২৯ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
আজ দুই সপ্তাহ যাবত বাসায় অবস্থান করছি। খাবার সময়মতো দরজার সামনে চলে আসছে৷ দরজা খুলে খাবার নিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দেই৷ এই যে বিলাশবহুল হোটেল, সময়মতো দরজার সামনে খাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস হাতের কাছে পাওয়া এগুলো ভাবতেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। আমাদের কোম্পানি ও সিঙ্গাপুর সরকারের প্রতি আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ৷
কথাগুলো বলছিলেন প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, আজকাল মন ভালো থাকে না৷ বহুদিন যাবত সূর্যের আলো চোখে পড়ে না৷ এখন আর দিন রাতের পার্থক্য বুঝি না৷ বিছানায় শুয়ে বসে আর কতক্ষণ কাটানো যায়। মাঝেমাঝে বই পড়তে বসি। বই হাতে নিলেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে৷ তখন লিখতে শুরু করি৷ এভাবে চলছে কোয়ারেন্টাইনের দিনগুলি।
কোয়ারেন্টাইন থাকা অবস্থায় রমজান শুরু হলো। জীবনে প্রথম এমন সাদামাটা রমজান পার করছি৷ অন্যান্য সময় রমজানে জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি থাকে কিন্তু এবার কোনো প্রস্তুতি নেই৷ অন্যান্য সাধারণ দিনের মতোই রমজানের দিনগুলো চলছে। সেহরি ও ইফতারের জন্য নেই কোনো বাড়তি আয়োজন।
রমজান শুরু হওয়ার সময় বারবার শৈশবের রমজান কথা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মানুষের জীবনে একটা সময় আসে যখন সে পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে থাকে। এখন রুমে অবস্থান করছি তাই মস্তিষ্ক বারবার পুরনো স্মৃতিগুলো ঘুরপাক করছে৷
আব্দুর রহিম নামে আরেক প্রবাসী বলেন, চোখের পাতা বন্ধ করে হারিয়ে যাই শৈশবের রমজানে। তখন রমজান মাস এলেই প্রাণটা নেচে উঠত খুশিতে। সবার সঙ্গে সেহরি খাওয়া, ইফতারি করা, মসজিদে দলবেঁধে তারাবি পড়ার সে কি আনন্দ। যদিও তখন নামাজের নিয়ম-কানুন কিছুই জানতাম না যতটুকু মনে পড়ে আমার সামনের ব্যক্তি যতবার সিজদায় যেত আমিও ততবার সিজদায় গিয়ে রাকাত পূর্ণ করতাম।
আর প্রবাসে আসার পর পরিবারের সবার সাথে সেহরি খাওয়া, ইফতারি করা হয় না৷ আর ১৪ ঘণ্টা ডিউটি করে এসে তারাবি পড়াও কষ্টকর। তাছাড়া অনেক সময় রাতের ডিউটি থাকায় নামাজের সুযোগ হয় না৷
কিন্তু এবার তো কোয়ারেন্টাইনে থাকায় নিজেকে শূন্য রিক্ত মনে হচ্ছে। নেই সেহরির আমেজ, নেই মসজিদ কিংবা বন্ধুদের সাথে বসে রুচিকর খাবার দিয়ে ইফতারের আমেজ৷ সবকিছু এত দ্রুত পাল্টে যাবে ভাবতেই পারিনি। মাঝেমাঝে মনটা নিজের অজান্তে কুঁকড়ে উঠে৷
এখন সেহরি খাই একা৷ তাও ঠান্ডা খাবার খেতে হয়৷ তবে শুকরিয়া যে কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য সেহরির ব্যবস্থা করেছে৷ ভোরে খেতে বসে মনটা অতীতের সেহরির কথা মনে পড়ে যায়।
আমার শৈশবে সবচেয়ে প্রিয় সময় ছিল ভোর রাতের সেহরি। ভোর রাতে ইমাম সাহেব ভরাট কণ্ঠে বলতেন, উঠুন সেহরি খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আর ঘুমাবেন না৷ মাঝেমাঝে তিনি সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। মনে পড়ে এখনো গ্রামের সেই রমজান মাসের বেহেশতি পরিবেশের কথা। আহা কত আনন্দময় সময় কাটাতাম৷ বলছিনে প্রবাসী তমাল হোসেন।
তিনি বলেন, কৈশোরের ইবাদত খুব নির্ভেজাল হয় বারবার ইচ্ছে করে আবার সেই কৈশোরের রমজানে ফিরে যাই। আম্মুকে জ্বালানোর মুহূর্তগুলো ফেরত দিয়ে দেই। কত বছর পরিবারের সাথে ইফতার করা হয় না। ভোর রাত পেরিয়ে উঠানে হাঁটতে হাঁটতে সুবহে সাদিক দেখা হয় না। আর হবে কিনা জানি না। হয়ত এই করোনাভাইরাস আমাদের সমস্ত সুখ কেড়ে নেবে। হয়ত এই পরিবারের সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ হয়ে গেছে। এই জীবনে আর সাক্ষাৎ হবে না৷
মিরাজ হোসেন বলেন, আজকাল ইফতারি সামনে নিয়ে বসলে গত বছরের ইফতারের স্মৃতি মনে পড়ে যায়৷ সব কলিগরা মিলে অফিসে উৎসবমুখর পরিবেশে ইফতার করতাম। ছোলা, আলুর চপ, পেঁয়াজু, বেগুনি রান্না করার দায়িত্ব থাকত আমার আর আনোয়ার ভাইয়ের উপর৷ দু’জন পালাক্রমে রান্না করে নিয়ে আসতাম।
তিনি বলেন, ‘ইফতারের আগ মুহূর্তে শরবত বানানো, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, ফল কাটার দায়িত্ব পড়ত আকরাম খাঁন ও আমিনুল ইসলামের উপর। তারা দু’জন খুব সুন্দর করে কাটাকাটি করতে পারে৷ জাহাঙ্গীর তাদের পাশে বসে সহায়তা করত৷ আমাদের আরেক কলিগ সে সিঙ্গাপুরিয়ান মুসলিম৷ তারা সাধারণত আমাদের মতো ছোলা, মুড়ি দিয়ে ইফতার করে না৷ কিন্তু আমাদের সাথে থাকতে থাকতে সেও ছোলা মুড়ি খাওয়া শিখেছে। গত বছর প্রায় সে আমাদের কাটাকাটি করে সাহায্য করত৷ আমাদের পাশে বসে মুড়ি খেত। তার মুড়ি খাওয়াটা উপভোগ করতাম৷ ভিনদেশি একজন মানুষ আমাদের বাংলাদেশি খাবার উপভোগ করছে ব্যাপারটি আমাদের আনন্দ দিত৷ কিন্তু এবার তা হচ্ছে না৷ ভাইরাস আমাদের সবাইকে সব আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছে’৷
আহা! কত সুন্দর দিন পার করেছি আমরা। জানি না আর কখনো এমন উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই আমার একত্রে ইফতার করতে পারব কিনা। এবার আমিনুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর দুজনই করোনায় পজিটিভ। তাদের জন্য মনটা কেঁদে উঠে। যদিও চিন্তা করার কিছু নেই তাদের শারীরিক অবস্থা ভালো। তবুও অবুঝ মন বারবার তাদের কথা মনে করিয়ে দেয়৷
আমিনুল ইসলাম ও জাহাঙ্গীরের জন্য সবাই মনেপ্রাণে দোয়া করি তারা যেন খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে৷ আমরা সবাই আবার আগের মতো একসাথে উৎসবমুখর পরিবেশে ইফতার করতে চাই। হে আল্লাহ তুমি আমাদের মাঝে যারা অসুস্থ তাদের সুস্থ করে দাও।