নিউইয়র্কে বাংলাদেশিদের ভরসার প্রতীক এক ডাক্তার
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ এপ্রিল ২০২০, ৪:৫৮ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
ভয়েস অব অ্যামেরিকা বাংলা বিভাগের নিউইয়র্ক প্রতিনিধি আকবর হায়দার কিরণ গেল মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিজের বসতঘরেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান তিনি। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। কুইন্সের এস্টোরিয়া মাউন্ট সিনাই হাসপাতাল। ততদিনে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে নগরীর সব হাসপাতালেই দর্শনার্থীর প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আর তাই কিরণের আত্মীয়-স্বজন কিংবা ঘনিষ্ঠজন কেউ তাঁর সাথে হাসপাতালে যেতে পারেননি। এমনকি দ্রুত প্রকট হতে থাকা করোনা-পরিস্থিতির কারণে টেলিফোনেও তাঁর খোঁজ-খবর নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেন একজন।
নিজের ডাক্তার পরিচয়ের সুবাদে খুব সহজেই তিনি হাসপাতালে অবস্থানরত সাংবাদিক কিরণের খোঁজ-খবর পেয়ে যান। পরিবারকেও জানান তাঁর সর্বশেষ পরিস্থিতির খবর। শুধু তাই নয়, কিরণের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে যা যা করা সম্ভব তার সবকিছুই তিনি করেন। এমনকি পরদিন এই সাংবাদিককে কুইন্স থেকে ম্যানহাটনে মাউন্ট সিনাইয়ের মূল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরও সার্বক্ষনিক খোঁজ-খবর নেয়া অব্যাহত রাখেন ভদ্রলোক। তিনি ডাক্তার ফেরদৌস খন্দকার।
নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে আগে থেকেই তিনি বেশ পরিচিত। জনপ্রিয়ও বটে। তবে চলমান কভিড ১৯ মহামারীর কালে নিজের পরিচিতি কিংবা জনপ্রিয়তাকে ছাড়িয়ে গেছেন এই ডাক্তার নিজেই। হয়ে উঠেছেন এখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটির নির্ভরযোগ্য এক ভরসার প্রতীক। অন্য অধিকাংশ ডাক্তার যখন করোনা আতংকে নিজ নিজ চেম্বার বন্ধ করে দিয়ে অনেকটা নিরুদ্দেশ হয়েছেন, সেই সময়ে ডাক্তার ফেরদৌস পুরোদমে চালু রেখেছেন তাঁর ডাক্তারী। তিনি একা নন, নিজের ক্লিনিক ওয়েস্টার্ন কেয়ারের আরও ক’জন ডাক্তারসহ ডজন দেড়েক সহকার্মী নিয়ে সর্বাত্মকভাবে সক্রিয় রয়েছেন তিনি। কেবল চিকিৎসা দেয়া নয়, রোগীদের সাহস যোগানো থেকে শুরু করোনা’র মতো রোগের সঙ্গে লড়াই করার কৌশল শেখানোর কাজও করে থাকেন ডা: খন্দকার।
বাংলাদেশের সিনিয়র ফটো সাংবাদিক সানাউল হক কয়েক মাস আগে সপরিবারে অভিবাসী হয়েছেন নিউ ইয়র্কে। এখনও নতুন এই শহরে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। টানা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ঘরেই চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। কয়েকদিন আগে হঠাৎ বেশি অসুস্থ বোধ করায় তাঁর স্ত্রী ও সন্তানরা রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়েন। সেখানেও অনেকটা দেবদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ডা: ফেরদৌস খন্দকার। প্রথমে টেলিফোনে খোঁজ-খবর নেন। পরদিন দুপুরে সশরিরে হাজির হয়ে যান তাঁর বাসায়। ডাক্তারকে সামনাসামনি দেখেই অনেকখানি সুস্থ হয়ে যান সানাউল হক।
কেবল আকবর হায়দার কিরন কিংবা সানাউল হকই নয়, করোনা-দুর্যোগের এই বৈরী সময়ের সূচনালগ্ন থেকেই কমিউনিটির মানুষের পাশে নিজের পূর্ণ সক্ষমতা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। টেলিফোনে, ভিডিও কলে কিংবা সশরিরে চিকিৎসা-সেবা দেয়া ছাড়াও কমিউনিটির লোকজনের মধ্যে ভাইরাস নির্মূলের বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ, ভাইরাসমুক্ত থাকার কৌশল সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালানো, এমনকি লকডাউন পরিস্থিতির কবলে পড়ে খাবারের সংকটে থাকা পরিবারগুলোর কাছে সীমিত পরিসরে খাবার পৌঁছে দেয়ার কাজটিও করছেন এই ডাক্তার সাহেব। আর এভাবেই চলমান মহামারীর অস্বাভাবিক সময়ে নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে এক আশা জাগানিয়া নির্ভরতার প্রতিকে পরিণত হয়েছেন ফেরদৌস খন্দকার।
নিউ ইয়র্কে তো বটেই, জন্মভূমি বাংলাদেশের মানুষের পাশেও এই দুর্দিনে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন ফেরদৌস। দেশে গত কয়েকদিনে করোনা’র দ্রুত বিস্তারের প্রেক্ষিতে ‘ করোনাসেবা ডটকম (পড়ৎড়হধংযবনধ.পড়স) ’ নামে একটি ওয়েবসাইট খুলে দেশের মানুষকে সহায়তা করবার চেষ্টা করছেন তিনি। এ ওয়েবসাইটের আওতায় চারজন ডাক্তারের সমন্বয়ে ঢাকায় গড়ে তোলা হয়েছে একটি চিকিৎসক পুল। চালু করা হয়েছে টেলিফোন হটলাইন (+৮৮০১৯৪৬৬৭৮৪২১ ও +৮৮০১৯৭৮৩১৮৮৩৩)। যে কেউ চাইলেই এসব নম্বরে ফোন করে অথবা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিনামূল্যে করোনা বিষয়ক চিকিৎসা-পরামর্শ নিতে পারবেন। দেশের কিংবা নিউ ইয়র্কের আরও চিকিৎসকরা চাইলে এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন বলে জানিয়েছেন ডা: খন্দকার।
তিনি বলেন, দুনিয়াবাসী এমন দুর্যোগ আগে কখনও দেখেনি। আতঙ্কিত ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই সবচেয়ে বড় মানবিকতা। বর্তমান দু:সময় আমাদের সামনে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। নিজের সাধ্যমতো মানুষের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে পারছি এটাই আমার সন্তুষ্টি।