শ্রীমঙ্গলে বন্যপ্রাণীদের অস্তিত্ব রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে ‘বণ্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন’
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মার্চ ২০২০, ৮:৪৬ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
শ্রীমঙ্গলের সিতেশ দেবের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনটি বর্তমানে দেশ-বিদেশের মানুষের দৃষ্টি কাড়লেও সরকারি সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা অভাবে টিকিয়ে রাখাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
শ্রীমঙ্গলের অন্যতম দর্শনীয় এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু প্রাণীদের চিকিৎসাই করে থাকে না, চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠা প্রাণীগুলোকে তাদের নিজেদের আবাসস্থলে ফিরিয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে সিতেশ দেব ১৯৭২ সালে তার মিশন রোডের বাসায় মিনি চিড়িয়াখানাটির গোড়াপত্তন করেন।
এর পর মানুষের ব্যাপক কৌতূহল ও দর্শক চাহিদার মুখে চিড়িয়াখানাটি সরকারি অনুমোদন সাপেক্ষে শহরতলির ভাড়াউড়া এলাকায় নিজের খামার বাড়িতে স্থানান্তর করেন।
দুর্ঘটনায় আহত কিম্বা বিপদগ্রস্ত প্রাণী বিশেষ করে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের রক্ষায় এবং সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন তিনি।
এর ধারাবাহিতকায় তার প্রতিষ্ঠিত বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন দেশ ও বিদেশে ‘সিতেশ বাবুর মিনি চিড়িলখানা’য় রূপ লাভ করেছে।
তিনি বলেন, বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে রেখে দর্শকদের মনোরঞ্জন এই সেবা আশ্রমের মূল উদ্যেশ্যে নয়। মূলত আহত বিপদগ্রস্ত প্রাণীদের পিতৃস্নেহে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তাদের মূল নিবাসে অবমুক্ত করাই এর মূল উদ্যেশ্য।
ফলে এই চিরিয়াখানা বিপন্ন, বিপদগ্রস্ত আহত বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ আশ্রয় ভূমি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় নানা প্রজাতির প্রাণী এখানে আশ্রয়, সেবাযত্ন ও খাদ্য দিয়ে সুস্থ করে পরে বনে অবমুক্ত করার জন্য রাখা হয়েছে। মাঝখানের এই সময়টিতে থাকা এসব প্রাণীদের দেখতে দেশ বিদেশের পর্যটক ও দর্শকরা এখানে ভিড় করেন।
কিন্তু প্রাণীদের উদ্ধার করে তাদের খাদ্য, যত্ন ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ্য করে বনে অবমুক্ত করা- এই দীর্ঘ ও ব্যায় সাপেক্ষ্য প্রক্রিয়াটি সিতেশ বাবুর ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্পন্ন করে আসলেও এ পর্যন্ত কোন সরকারি সহায়তা মিলেনি।
পাওয়া যায়নি সরকারি কোন পৃষ্ঠপোষকতা। ফলে ব্যাক্তি উদ্যোগে এই জটিল কর্মযজ্ঞ অব্যাহত রাখা তার পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে ৩১ প্রজাতির বিপদাপন্ন বণ্যপ্রাণী সেবাযত্ন ও চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ্য করে বিভিন্ন সময়ে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে বনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় নানা প্রজাতির প্রাণী। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে অবমুক্তকরা প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে- ২৯টি মেছো বাঘ, ২৪টি লজ্জাবতি বানর, ২৯টি গন্ধগোকূল, ৪৫টি অজগর সাপ, ৭টি সবুজ বুড়াল সাপ, ৫টি শংখীনি সাপ, ৫টি ফণী মনসা সাপ, ১টি কালনাগিনী সাপ, ১৭টি সাধারণ প্রজাতির বানর, ১২টি তক্ষক, ৫টি সোনালী বিড়াল, ২৬টি বন বিড়াল, ১টি হিমালয়ান পাম সিভেট, ১টি হনুমান, ১টি বনরুই, ৩টি গুঁইসাপ, ৩টি বন্য শূকুর, ৫টি উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, ১টি লেজবিহীন চিকা, ১টি বোম্বেটিনকেট গ্লেইক, ১টি ধনেশ পাখি, ৩টি কাছিম, ৮টি পেঁচা, ১টি পদ্মগোখরা সাপ, ১টি শেয়াল, ১টি হিমালয়ন ডোরা সাপ, ১টি দুধরাজ সাপ, ১টি দাঁড়াশ সাপ, ৩টি পিট ভাইপার, ১টি বাজ পাখি ও বিভিন্ন প্রজাতির ১৩২টি পাখি।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত সেবা আশ্রমে নানা প্রজাতির হাজারো বিপদগ্রস্ত অসহায় ও দুর্ঘটনায় পতিত বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে এখানে নিয়ে এসে নিবিড় পর্যবেক্ষণ, সেবা যত্ন ও চিকিসৎসা দিয়ে আবারও বনে ছেড়ে দেয়া হয়।
এসব প্রাণীদের চিকিৎসাসেবা ও প্রাণীদের খাদ্যাভাস অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে প্রাণীদের আবারও বনে রেখে আসা পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটি জটিল ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়।
কিন্তু দীর্ঘ এই সময়ে কোন অর্থ সহযোগিতা পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। স্থানীয়ভাবে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে সংগ্রহিত টিকিট থেকে প্রাপ্ত অর্থ খুবই অপ্রতুল।
বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক সজল দেব বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের প্রচেষ্টায় কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক প্রাণীদের আবাসনের জন্য কিছু খাঁচা তৈরি করে দিয়েছে।
এ জন্য তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ওই গভর্নরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, সেবা ফাউন্ডেশনের জন্য তার সেই সহায়তা আমাদের অনুপ্রাণীত করেছে।
তিনি বলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল ও প্রাণীদের চিকিৎসা ও খাদ্য সরবরাহে প্রতিদিন বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করতে হয়।
এ জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজনীতার কথা উল্লেখ করে সজল বলেন অর্থসংকটের মুখে সেবা আশ্রমটিকে টিকে রাখা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
সিতেশ রঞ্জন দেব প্রাণীদের শুধু ভালোই বাসেন না। এদের সেবাযত্নও করেন পিতৃসম ভালোবাসায়। আগত দর্শনার্থীদের প্রাণী সম্পর্কিত যে কোনো তথ্য দিতে তার যেন কোনো কান্তি-অবসাদ নেই। সদা হাস্যোমুখে তিনি সবাইকে অভিবাদন জানান।
বিপন্ন প্রজাতির এসব পশুপাখি স্বচক্ষে দেখে নতুন প্রজন্ম কিছু জানতে পারছে।
তাই এই দর্শণীয় প্রতিষ্ঠানটি টিকে রাখতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন স্থানীয়রা।