চোর চক্র উজাড় করছে বন: চরম সংকটে ‘লাউয়াছড়া’ জাতীয় উদ্যান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ৬:০১ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
চোর চক্র উজাড় করছে বন। আর পাহাড়ি টিলার গাছ ও জমি দখলদারিত্বে মত্ত প্রভাবশালী মহল। ওই দুষ্টু চক্রের লোলুপ দৃষ্টিতে ধ্বংস হচ্ছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ‘লাউয়াছড়া’ জাতীয় উদ্যান। হারিয়ে ফেলছে প্রকৃতির ভারসাম্য। নানা কারণে সংরক্ষিত এই বনটির নেই আগের সেই জৌলুস। বলতে গেলে মানবসৃষ্ট নানা সংকটে ঐতিহ্য ধরে রাখতে হিমশিম খাওয়া এ উদ্যানটি এখন অনেকটাই ধ্বংসের দোরগোড়ায়। যেভাবেই হোক অন্তত লাউয়াছড়ার নাম টিকিয়ে রাখতে অবশিষ্ট এই গাছগুলো ওদের কবল থেকে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবাদীসহ স্থানীয়রা।
জানা যায়, ১৯৯৬ সালে ১২৫০ হেক্টর জায়গা নিয়ে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে লাউয়াছড়া বনকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সেই সময়ে লাউয়াছড়ায় ৪৬০ প্রজাতির জীববৈচিত্র্যের মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ১৭ প্রজাতির পোকামাকড় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সময়ের সাথে চোর চক্র তৎপর হয়ে উঠে। সেই সময়ের গাছে ভরপুর লাউয়াছড়া এখন বৃক্ষ শুন্য হয়ে পড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় প্রতি রাতে চোর দল সেগুন, লোহা কাঠ, আগরসহ মূল্যবান গাছগুলো কেটে পাচার করেছে। তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তাদের আশঙ্কা এভাবে চলতে থাকলে যে ক’টি বড় গাছ এখনো কোনো রকমে টিকে আছে তাও উজাড় হয়ে যাবে। চোর চক্রের শকুনি দৃষ্টি ওই গাছগুলোর ওপর। এই জাতীয় উদ্যানটির সংকটের তালিকা প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু বয়ে চলা সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্টদের নেই কোনো মহাপরিকল্পনা কিংবা স্থায়ী উদ্যোগ। লাউয়াছড়া উদ্যানটি এখন চরম সংকট ও ঝুঁকিতে। এর অন্যতম কারণ উদ্যানটির সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ফলদ ও বনজ গাছ চুরি, বাঁশ চুরি, ভূমি বেদখল, বন্যপ্রাণীর খাবার, আবাসস্থল ও অবাধ বিচরণের জায়গা কমে যাওয়া ও শুষ্ক মৌসুমে খাবার পানি
সংকট। তাছাড়া লাউয়াছড়ার ভিতর দিয়ে বৈদ্যুতিক তার ও খুঁটি টানানো। বনের শত শত একর জায়গা প্রভাবাশীলীদের দখলে। উদ্ধারের কোনো তৎপরতা নেই বন বিভাগের।
পরিবেশবিদ ও গবেষকদের অভিমত, বনের আয়তন কমে যাওয়া, পুশ-পাখিদের খাদ্যের জন্য পর্যাপ্ত ফলদ বৃক্ষ, মানুষের আগাগোনায় বন্যপ্রাণীদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। ওরা ভয়ে ভীত থাকছে। যার ফলে ওরা আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগবালাইয়ে। প্রায় সময় দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণী মারাও যাচ্ছে। ভীত হয়ে নিজেদের আবাস্থল ছেড়ে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে প্রতিনয়িত। শুধু মানুষ নয় প্রাকৃতিক দুর্যোগে লাউয়াছড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৯ সালের প্রচণ্ড ঝড়ে বনের ভিতরে শতাধিক গাছগাছালি উপড়ে পড়ে। এতে করে বনের মধ্যে পশু-পাখি বসার অসুবিধা হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আগের লাউয়াছড়ায় যে বনজঙ্গল আর লতাগুল্ম ছিল তা এখন আর নেই। এর জন্য দায়ী স্থানীয় একটি প্রভাবশালী বনখেকো চক্র। উদ্যানটিতে এখন শুধু নেই আর নেই। ঐতিহ্যবাহী ক্লোরোফর্ম গাছ নেই। নেই চন্দন, আগর, সেগুন, চাপালিশসহ নানা প্রজাতির বৃহদাকার গাছ। ফাঁকা বনে চুরি হওয়া গাছের সাক্ষী হয়ে থাকছে গাছের মোথা। বনের যে টিলায় টিলায় দেখা যাবে বৃক্ষ শুন্য। খোদ বিট অফিসের সামনে থেকেই গাছ চুরি হয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের আগাগোনায় বানরসহ অন্যান্য প্রাণীগুলো বনের বাহিরে চলে যায়। বিগত এক বছরে অজগর সাপ, মেছো বাঘ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ শতাধিক বন্যপ্রাণী লোকালয়ে মানুষের হাতে ধরা পড়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে উদ্ধারকৃত বন্যপ্রাণীগুলো অসুস্থ অবস্থায় ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বন্যপ্রাণী বিভাগের বিরুদ্ধে। এক কথায় ১০ বছর আগের লাউয়াছড়া এখন নেই। বৃক্ষহীন লাউয়াছড়া। আগেও গাছ চুরি হয়েছে। বনবিভাগের লোকজন মাঝে মাঝে কিছু গাছ উদ্ধার করে দায়িত্ব পালন করছে।
গাছ চোররা অভিনব নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রতিনিয়ত গাছ চুরি অব্যাহত রাখলেও তাদের প্রতিহত করতে নেই সমন্বিত পদক্ষেপ কিংবা কৌশল। বরং অস্ত্র ও পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে চুরি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না এমন অজুহাত সংশ্লিষ্ট বিভাগের।
তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা অভিযোগ করে বলছেন, ওই চোর চক্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা- কর্মচারীর। তাদের সঙ্গে আঁতাত করেই চুরি হয় ওখানকার মূল্যবান বনজ সম্পদ।
বন বিভাগের একটি সূত্র জানায়, লাউছয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রকৃতি রক্ষার জন্য সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। কিন্তু ওই কমিটির বর্তমান দুই বছরের মেয়াদ শেষ হয়েছে ডিসেম্বরে। সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি কার্যক্রম না থাকায় বনবিভাগের সংশ্লিষ্টরা কিছুটা দায়িত্ব পালনে গাফলতি রয়েছে।
লাউয়াচড়া বনের পার্শ্ববর্তী টিলা গাও,বটতলা, উত্তর বালিগাঁও গ্রামের আলম মিয়া, মেরাজ বলেন, বনে খাবার সংকটে রাতে শিয়াল, শূকর, বানর, হরিণ, অজগরসাপসহ ওখানকার বনের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে বেড়িয়ে আসে। অভুক্ত এই প্রাণী খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে এসে তাদের ক্ষেতের ধান ও ফসলের মাঠ নষ্ট করে। অভুক্ত এই প্রাণীদের হিংস্র আচরণে আশপাশের লোকজন অতিষ্ঠ।
মৌলভীবাজার জেলা পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সম্পদক নুরুল মোহাইমিন বলেন, গাছ চুরির কারণে ধ্বংস হচ্ছে লাউয়াছড়া। বনে ফলদ বৃক্ষ না থাকায় বন্যপ্রাণী আবাস্থল নষ্ট হচ্ছে। তাই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।
কমলগঞ্জের গবেষক আহমদ সিরাজ বলেন, বনকে বনের মতো রাখতে হবে। তা না হলে প্রাকৃত্কি ভারসাম্য রক্ষা হবে না। লাউয়াছড়ায় বন উজার হওয়ায় প্রকৃতিতে বিরুপ প্রভাব পড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে লাউয়াছড়া বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের শ্রীমঙ্গলস্থ রেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে ফোন রিসিভ করেননি।
এ ব্যাপারে কমলগঞ্জ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের কো-ম্যানেজম্যান্ট কমিটির সভাপতি ও নিবার্হী অফিসার আশেকুল হক বলেন, আগের চেয়ে গাছ চুরি কিছুটা বন্ধ হয়েছে। তবে কিছু অভিযোগ রয়েছে তা সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে। বর্তমানে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে তাই কার্যক্রম কিছুটা মন্তর।