সিলেটের উন্নয়নে একজন নিবেদিত প্রাণ মানুষ ছিলেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ জুলাই ২০১৯, ৪:৫১ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
দক্ষিণ এশিয়ার জাঁদরেল কূটনীতিক, পররাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্পিকার মরহুম হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর কথা বলছি। আজ ১০ জুলাই তার মৃত্যুবার্ষিকী। সিলেট অন্তপ্রাণ এই মহান মানুষটি সিলেটের উন্নয়নে ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ মানুষ। রাজটিকা কপালে নিয়ে জন্মেছিলেন সুনামগঞ্জের এক অভিজাত পরিবারে। মানুষের কল্যাণে তার হৃদয়খানি ছিল খোলা। সিলেটের অনেকেই তার আনুকুল্য নিয়েছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে পরিবার পরিজনসহ নির্মমভাবে হত্যা করার পর বাংলাদেশে এক অন্ধকার বিভীষিকাময় পরিস্থিতি নেমে এসেছিল। বঙ্গবন্ধুর দুইকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন দেশের বাইরে থাকায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। যেখানে শিশুপুত্র রাসেলকে ঘাতকরা রেহাই দেয়নি, সেখানে মুজিব কন্যারা দেশে থাকলে খুনিচক্র রেহাই দিত না। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ছিলেন দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিল তার অকুণ্ঠ সর্মথন। সেই আগস্টের কালো রাতে হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ছিলেন পশ্চিম জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। বঙ্গবন্ধুই তাকে সেখানে পাঠিয়ে ছিলেন। আর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট বন্ধু সানাউল হককে বেলজিয়ামে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়েছিলেন। সেই রক্তার্ক্ত আগস্টের দিনে গোটা পরিবার হারানো বেদনায় শোক বিহ্বল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায়। সঙ্গে ছিলেন শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী মরহুম ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া। কিন্তু সানাউল হক সেদিন চোখ পাল্টে ছিলেন। জাতির জনকের কন্যাদের তার বাড়িতে আশ্রয় দিতে চাননি। অসহায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবিত দুইকন্যাকে যার জার্মান পাঠিয়ে দিতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ফোন করেছিলেন সানাউল হককে। সেখান থেকে সানাউল হক তার গাড়িটি পর্যন্ত দেননি সীমান্তে আসার জন্য। কিন্ত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জার্মান সীমান্ত থেকে গাড়ি পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যাদের তার কাছে এনেছিলেন। সেখানে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গেও তাদের দেখা হয়েছিল। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও তার স্ত্রী গভীর সমাবেদনা ও মমতা নিয়েই তাদের পাঁশে দাঁড়াননি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধির সঙ্গে যোগাযোগ করে দিল্লি পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। কারণ তার জার্মানের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর দুইকন্যা আছেন শুনে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়া জাসদের কর্মীরা হামলা করেছিল। জার্মান পুলিশ ডেকে তিনি তাদের সরিয়ে দিয়েছিলেন। এদিকে অবৈধ খুনি মোশতাক সরকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় তলব করেছিলেন।
দীর্ঘ কূটনীতিক জীবনের চাকুরি শেষে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এরশাদ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ও পরবর্তীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন। সৌদি রাজ পরিবারের আপনজন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আরব দুনিয়াও রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তিনি সিলেটের হযরত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়টি আদায় করেছিলেন সেনাশাসক এরশাদের কাছ থেকে। এরশাদের ভূমিমন্ত্রী হয়েছিলেন সাবেক আইজিপি মরহুম এমএ হক। কিন্তু এমএ হক সিলেট গেলে মানুষের চেয়ে পুলিশের উপস্থিতি থাকত বেশি। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এরশাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার পর সিলেট পৌরসভার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আফম কামালকে তার সঙ্গে টানেন ব্যক্তিগত সর্ম্পকের সুবাদে।
সিলেটের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সিলেটে তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। এরশাদ সিলেটে নামতে পারছেন না। কারাবন্দি ও কারামুক্ত নেতাদের সঙ্গে আফম কামালকে দিয়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এরশাদকে সিলেট নিয়ে প্রথম জনসভা করান। আর বিনিময়ে এরশাদ সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং নগরীর উন্নয়নে পৌরসভায় এককোটি টাকা অনুদানের ঘোষণা দেন। অথচ সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি হল বা ভবন তার নামে আজও প্রতিষ্ঠা করেনি। ‘৮৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি সিলেট সদর ও সুনামগঞ্জ-৩ আসন থেকে বিজয়ী হন। প্রতিনিধিত্ব করেন সিলেট সদর থেকে। ‘৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার অনুরোধে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদেন। ওই নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে সিলেট সদরে তিনি আরেক কৃত্বি সন্তান মরহুম অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানকে পরাজিত করেন। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে ‘৭৩ সালের পর এই আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে তার ঘাঁটি শক্তিশালী করে এবং একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। তাকে সপ্তম সংসদে স্পিকার নির্বাচিত করা হয়। উচ্চশিক্ষিত দিল দরাজ উদার ভদ্র বিনয়ী এই মানুষটি সংসদ পরিচালনায় দক্ষতাই দেখাননি। তিনি সবকটি মোনাজাত নিজে পরিচালনা করতেন। আরবী, ফার্সি, বাংলা মিলিয়ে করা তার মোনাজাত সংসদকে তন্ময় করে দিত। তরুণ বয়সে বোম্বে চলচ্চিত্রের অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন এই সুদর্শন মানুষটি।
সিলেটের-কোম্পানিগঞ্জ ছিল এক অবহেলিত জনপদ। যোগাযোগ বলে কিছুই ছিল না। ছিল না স্বাস্থ্য, শিক্ষার ব্যবস্থা। এই থানাকে নিজে গড়ে গেছেন স্বপ্নের মতো।