লাউয়াছড়া বনের রেলপথ যেন মৃত্যু ফাঁদ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ জুলাই ২০১৯, ৬:১৪ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
রেললাইনের রেলপাত ক্ষয় হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। রেললাইনের পাতের জয়েন্টে ৪টি নাটের জায়গায় আছে ২-৩টি। জয়েন্টে নাট-বল্টু না থাকায় স্লিপারের হুক খুলে পড়ছে। স্লিপারের মধ্যখানে পাথরের পরিবর্তে বালু, কোথাও পাথরবিহীন রেল লাইনটি শূন্যে রয়েছে। সরজমিনে সিলেট রেলপথের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরের রেললাইন ঘুরে চরম ঝুঁকিপূর্ণ এ দৃশ্য চোখে পড়ে। যেন লাউয়াছড়া বনের ভেতরের রেলপথ সাজানো রয়েছে মৃত্যুর ফাঁদ। দশের নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার শীর্ষস্থানে রেলপথ থাকলেও সিলেট রেলপথের অধিকাংশ স্থানের অবস্থাই অত্যন্ত নাজুক। তার চেয়েও নাজুক লাউয়াছড়া বনের রেলপথটি। ১৯৯৭ সালে ১৪ই জুন কমলগঞ্জের মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে শত বছরের পুরনো সিলেট রেলপথটির লাউয়াছড়া বনের রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এর ফলে সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ ছিল কয়েক মাস। পরে ক্ষতিগ্রস্ত লাইনটি সংস্কার করার পর বনের ভেতরের অংশ আর সংস্কার কিংবা মেরামত না করায় বনের ভেতরের ৮ কি.মি. রেলপথের পুরো লাইন জুড়েই বর্তমানে শুধু নেই নেই অবস্থা। জয়েন্টে নাট-বল্টু নেই, স্লিপার ভাঙা, স্লিপারের হুক নাই, রেললাইনের স্লিপারে পাথর নেই, পাথরের পরিবর্তে স্লিপারের মধ্যখানে বালু দিয়ে রাখায় রেললাইনের নড়বড়ে অবস্থা। এ অবস্থায় নড়বড়ে এ রুটেই ঘটে দেশের সব চেয়ে বেশি ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা। জানা গেছে, শুধু লাউয়াছড়া বন নয় পুরো সিলেট রেলপথ জুড়েই রেললাইনে ক্লিপ, নাট, হুক, ফিসপ্লেট, স্লিপার, গার্ডার বয়সের ভারে ন্যুব্জ। একে অপরের পরিপূরক পুরাতন ওই খুচরা নানা ছোট-বড় যন্ত্রাংশ এখন অধিকাংশই অকেজো। আর যেগুলো আছে রয়েছে, সেগুলোও সংখ্যায় অপ্রতুল। রেলপথে নির্মাণকৃত ব্রিজগুলো নির্মাণের পর থেকে এখন পর্যন্ত অধিকাংশ ব্রিজে কোনো মেরামত কাজ হয়নি। এর ফলে অনেকটা ব্রিজের উপরের রেললাইন রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।
রেল সূত্রে জানা গেছে, সিলেট রেলপথের কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনের দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। এরমধ্যে লাউয়াছড়া বনের ভেতরে রয়েছে ৮ কি.মি. রেলপথ। এই পথের মধ্যে ছোট-বড় ৬টি ব্রিজ রয়েছে। সরজমিনে লাউয়াছড়া বনের ভেতর ঘুরে দেখা যায় মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি থেকে চোংগার পুল পর্যন্ত রেললাইনের অবস্থা খুবই নাজুক। পাহাড়ি এলাকার এই অংশের মধ্যে রেললাইনের একটি স্থানে রেলপাত অংশ গলে ক্ষয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। জয়েন্টের প্লেটের ৪টি নাট-বল্টুর মধ্যে কোথায় ২-৩টি রয়েছে। কোনো কোনো জয়েন্টে নাট থাকলে বল্টু নেই। আবার কোথাও নাট ক্ষয়ে যাওয়ায় কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। জয়েন্টে নাট-বল্টু না থাকায় রেলপাতগুলো উঁচুনিচু হয়ে বেশ কম অবস্থায় রয়েছে। এক স্থানে ১২টি স্লিপারের মধ্যখানে কোনো পাথর নেই, পাথরের পরিবর্তে দিয়ে রাখা হয়েছে বালু। অধিকাংশ স্লিপার ভাঙা। স্লিপার ধরে রাখার হুক খুলে পড়ে আছে। রেললাইনের কোনো কোনো স্লিপারে নাট-বল্টু নেই। আবার কোনোটাতে একটি, আবার কোনোটাতে একটিও নেই। অনেক স্থানে কাঠের উপর থেকে লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কোথাও স্লিপার ভেঙে পাথরবিহীন রেললাইন শূন্যে রয়েছে। শ্রীমঙ্গল থেকে ভানুগাছ রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত প্রতিটি স্থান মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়েছে। লাউয়াছড়া বনের পাহাড়ি রেলপথ এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে যাত্রীরা দেখলে হয়তো এই পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতেন না।
তবুও নড়বড়ে রেললাইনের উপর ভর করে হাজারো জীবন নিয়ে প্রতিদিন ছুটে চলে ৬টি আন্তঃনগরসহ বেশ কয়েকটি লোকাল ট্রেন। রেল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথে পারাবত, জয়ন্তীকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনী এক্সপ্রেস নামের ৬টি আন্তঃনগর ট্রেন প্রতিদিন দু’বার করে ১২ বার আসা-যাওয়া করে। আর এই পথে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করেন অন্তত ২৫-৩০ হাজার যাত্রী। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলতে রাজি না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেল কর্মকর্তার সঙ্গে রেললাইনের ত্রুটি নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, কিছু কিছু অংশে সমস্যা আছে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই বলে ওই রেলওয়ে কর্মকর্তা জানালেও গত তিন বছরে সিলেট রেলপথে অন্তত ২০-২৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সব চেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৩শে জুন রাতে কুলাউড়ার বরমচাল এলাকার বড়ছড়া সেতুতে। ওইদিন সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেন সতু ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটলে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে।
সাধারণ যাত্রীরা বলেন, ‘আমরা রেলপথকে সব চেয়ে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা মনে করি। কিন্তু সিলেট রেলপথটি এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে কি বলব। এ রেলপথটি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রহস্যজনক কারণে এই পথটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য রেল বিভাগের স্থানীয় কৌশলীদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা যায়নি। রেলের স্থানীয় পর্যায়ের কেউও এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
সুত্রঃমানবজমিন