স্মরণ কালের দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে সিলেট, আবারো বাড়ছে পানি
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ জুলাই ২০১৭, ১১:৩৯ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
কয়েক দিন উন্নতির পর গতকাল আবার অবনতি হয়েছে সিলেট অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির। সুরমা ও কুশিয়ারা দুই নদীর পানিই এ দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে সিলেটে স্মরণ কালের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতি। দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট ও মৌলভীবাজারের পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ।
এতো দীর্ঘ সময় ধরে বন্যা থাকাকে অস্বাভাবিক বলছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। বন্যা আরো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা থাকে। জুনের প্রথম দিকে এই দুই জেলায় বন্যা দেখা দেয়। প্লাবিত হয়ে পড়ে সিলেটের অন্তত ৬ ও মৌলভীবাজারের ৩ উপজেলা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাররা জানিয়েছেন, ২০০৪ সালে সিলেটে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেখা দেয়। যা অঞ্চলভেদে ১৫-২০ দিন স্থায়ী ছিল। তবে এবারের বন্যা স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, এবার বন্যার আচরণ অস্বাবাভিক। এতো দীর্ঘসময় কখনো বন্যা থাকে না। পরিস্থিতি দেখা মনে হচ্ছে বন্যা আরো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
এদিকে, টানা তিনদিন পানি কমলেও রোববার ফের বাড়তে শুরু করেছে সিলেটের প্রধান দুই নদীর পানি। তিনটি পয়েন্টে পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সোমবারও দিনভর সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে পানি আরো বাড়তে পারে বলে শঙ্কা পাউবোর।
পানি নামতে না পারায় বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে বলে মনে করেন পাউবোর কর্মকর্তারা। গত ৩/৪ দিন উজানে ও সিলেটে বৃষ্টিপাত না হলেও পানি খুব একটা কমে নি বলে জানান তারা।
পাউবোর সিলেট কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, এবার পানি বিচিত্র আচরণ করছে। বৃষ্টি থামলেও পানি কমছে না। সিলেটে এমন কখনো হয় না। সিলেটে বৃষ্টি হলে দ্রুত বন্যা হয়ে যায় এবং এবং বৃষ্টি থামলে পানি দ্রুত নেমেও যায়। কিন্তু এবছর পানি নামতে পারছে না। ফলে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।
পানি না নামার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। হাওর ও নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়াও একটি কারণ। তবে পর্যালোচনা না করে এ ব্যাপারে হুট করে কিছু বলা যাবে না।
তিনি জানান, প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ সুরমা নদীর ১১০ কিলোমিটারই পড়েছে সিলেটে। গত দুই দশকে এই ১১০ কিলোমিটারের ৪০-৪৫ শতাংশ অংশে চর পড়েছে। যেখানে চর পড়েনি, সেখানে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এ ছাড়া প্রায় ২১০ কিলোমিটার দীর্ঘ কুশিয়ারার ১২০ কিলোমিটার পড়েছে সিলেটে। এ নদীতে খুব বেশি চর না পড়লেও গভীরতা অনেকটাই কমে এসেছে। নদী দুটির অন্তত ৩৫-৪০ কিলোমিটার অংশ উভয় দেশের আওতাধীন থাকায় একাধিকবার খননের উদ্যোগ শুরু করেও শেষ পর্যন্ত নানা কারণে সফল হয়নি।
সিলেট আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবার ভারতীয় অংশে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে যৌথ নদীগুলো দিয়ে সেই পানি মাসখানেক ধরে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশে ঢুকছে। এছাড়া গত জুনে সিলেটে রেকর্ড ১ হাজার ১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
এদিকে, সিলেটের হাওরাঞ্চলে আগে থেকেই বন্যা সৃষ্টি হওয়ায় পুরোনো পানি স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। নতুন করে পানি ঢুকায় বন্যা দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিয়েছে।
এদিকে, অস্বাভাবিক দীর্ঘ সময় ধরে পানিবন্দি অবস্থায় থাকায় চরম দূর্ভোগে পড়েছেন বন্যা কবলিত এলাকার মানুষেরা। খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সঙ্কটের পাশাপাশি নানা ধরণের পানিবাহিত রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। বন্যা ভেঙ্গে গেছে অনেকের বাড়িঘর। সরকারী ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগও করেছেন অনেকে।
তবে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শহীদুল ইসলাম চৌধুরী খাদ্য সঙ্কট ও ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে সকল ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিদের নিয়ে সমন্বিতভাবে ত্রাণ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তারর্পও অভিযোগ উঠা দুঃখজনক।
তিনি বলেন, এখনো আমাদের কাছে প্রচুর ত্রাণ মজুদ রয়েছে। জেলা প্রশাসকের ত্রাণ তহবিলে সাড়ে ৬শ’ মেট্রিক টন চাল ও ৯ লাখ টাকা রয়েছে। প্রয়োজন হলে আমরা সরকারের কাছে আরো ত্রাণ চাইবো। যতদিন পর্যন্ত ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে হয় আমরা চালিয়ে যাবো।
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. হিমাংশু লাল বলেন, বিশুদ্ধ পানির সংকট মোকাবেলায় যথেষ্ট পরিমাণ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হচ্ছে। উপদ্রুত এলাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় ৭৮টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। এছাড়া আরো ৭০টি মেডিকেল টিম প্রয়োজনে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটে বন্যাকবলিত উপজেলাগুলো হলো— জকিগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ওসমানীনগর ও বালাগঞ্জ। এছাড়া দক্ষিণ সুরমা ও কানাইঘাট উপজেলাও আংশিকভাবে প্লাবিত হয়েছে।