লন্ডনের বিশ্ববিখ্যাত ইটন কলেজে সিলেটী কাশীফ
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ মার্চ ২০১৭, ১১:৩৬ অপরাহ্ণ
লন্ডন অফিসঃ ইটন কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে সিলেটী কাশীফ কামালী। যে কলেজে পড়েন বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিদের সন্তানরা। ব্রিটেনের প্রিন্স চার্লস তার সন্তান প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারীও পড়েছেন ইটন কলেজে।
ভালো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তানের ভর্তি হওয়া হয়তো কোনো পরিবারের জন্য বড় ব্যাপার হতে পারে। কিন্তু তা কি জাতীয় আলোচনার মতো কিছু? অথচ তা-ই হয়েছে যুক্তরাজ্যে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কাশীফ কামালী বিশ্বখ্যাত ইটন কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। এ খবর চাউর হতেই সাড়া ফেলে দেশটির গণমাধ্যমে। আইটিভি শিরোনাম করেছে, ‘পূর্ব লন্ডনের ছেলে পড়তে যাচ্ছে ইটনে’। একাধিক সংবাদপত্রের শিরোনাম, ‘বাংলাদেশি অভিবাসীর ছেলের অভিজাত ইটনে ভর্তির সুযোগ লাভ’।
তবে কি পূর্ব লন্ডন কিংবা অভিবাসী মা-বাবার সন্তানেরা ইটনে পড়ে না? অনেকটা তা-ই। বিত্তবান ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানেরাই মূলত অভিজাত এই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। দুই ব্রিটিশ রাজপুত্র প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারি পড়েছেন এ প্রতিষ্ঠানে। যুক্তরাজ্যের ১৯ জন প্রধানমন্ত্রীর জন্ম দিয়েছে ইটন। সাড়া জাগানো স্পাই চরিত্র জেমসবন্ডের স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিংও ইটনের ছাত্র। আর গুগলে ‘ইটোনিয়ান’ খোঁজ করলে মূহূর্তেই মিলবে শত শত খ্যাতিমানের নাম। ‘ইটোনিয়ান’ মানে যাঁরা ইটনে পড়াশোনা করেছেন। এই বিখ্যাত ইটোনিয়ানদের কাতারে যুক্ত হতে যাচ্ছে পূর্ব লন্ডনে বেড়ে ওঠা এক অভিবাসী পরিবারের সন্তান কাশীফ। শুধু মেধার জোরে প্রায় ৭৬ লাখ টাকার (৭৬ হাজার পাউন্ড) বৃত্তি পেয়ে সে এখানে ‘এ’ লেভেল করার সুযোগ পেয়েছে। চমকটা এ কারণেই।
১৫ বছর বয়সী কাশীফ পূর্ব লন্ডনের ফরেস্টগেট কমিউনিটি স্কুলের জিসিএসই (এসএসসি সমমান) পরীক্ষার্থী। তার জিসিএসই পরীক্ষা হবে আগামী মে মাসে। আর সেপ্টেম্বর থেকে ইটনে শুরু করতে হবে ‘এ’ লেভেল পড়া। জিসিএসই পরীক্ষায় সব কটি বিষয়ে সে ‘এ’ স্টার’ পেতে পারে বলে আভাস দিয়েছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
কাশীফের বাবা শাহ রাবু মিয়া হিথরো বিমানবন্দরের একজন সরকারি কর্মকর্তা। মা শিউলি বেগম কাজ করেন মানসিক রোগীদের নিয়ে। তিন ভাইবোনের মধ্যে কাশীফ দ্বিতীয়।
বড় ভাই ইহতিশাম কামালী পড়ছেন হিসাববিদ্যা নিয়ে। ছোট বোন তাসনীম কামালী পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বাংলাদেশে এই পরিবারের বাড়ি জগন্নাথপুরের শাহারপাড়া গ্রামে।
ইটনে পড়ার সুযোগ পাওয়ার খবরটি পরিবারটির কাছে রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঠেকে। ৭ মার্চ টেলিফোনে কথা বলার সময় উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে কাশীফ বলে, ‘খবরটি প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি আমার। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাধারণ পরিবারের কেউ ইটনে পড়বে, এটা কি সম্ভব? অনেকের কাছেই এটা অভাবনীয়।’
কাশীফ যেভাবে ভর্তির সুযোগ পেল
স্কলার্স প্রোগ্রাম নামে একটি ওয়েবসাইট আছে, যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাবৃত্তি সম্পর্কে খোঁজখবরের পাশাপাশি নানা উপদেশ পাওয়া যায়। বলছিল কাশীফ। ইটনে আবেদনের প্রথম ধাপ ছিল ‘কেন ভর্তি হতে চায়?’ সে বিষয়ে বিস্তারিত লিখে পাঠানো। এরপর কলেজের ছাত্রাবাসে রেখে চার দিনের যাচাই পরীক্ষা। পড়ার আগ্রহী ছয়টি বিষয়ে আলাদা আলাদা মূল্যায়ন। তারপর মৌলিক যোগ্যতা যাচাইয়ে বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার। শেষে কোনো একটি বিষয়ে দীর্ঘ রচনা লিখতে হয়। এসব পর্ব শেষ করার কিছুদিন পরেই খবর আসে গণিত, ইংরেজি, ইতিহাস এবং সরকার ও রাজনীতি বিষয়ে বেশ ভালো করেছে কাশীফ। এ চারটি বিষয় নিয়ে ‘এ লেভেল’ করার জন্য তাকে বৃত্তি দেওয়া যায়।

বাবা-মা ও ভাইবোনের সঙ্গে কাশীফ (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
হৃদয়ের গহিনে বাংলাদেশ
৩ মার্চ আইটিভির সাক্ষাৎকারে উপস্থাপক বেশ মজা করেই প্রশ্ন করেছিলেন—ইটন থেকে বের হয়েছেন ১৯ জন প্রধানমন্ত্রী, বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র তারকা; কাশীফ কোন পথে যাবে? দ্যুতি ছড়ানো হাসিতে কিশোর কাশীফের জবাব ছিল, ‘সম্ভবত রাজনীতি, অভিনয় আমাকে দিয়ে হবে না। প্রধানমন্ত্রী হতে না পারি, অন্তত অর্জিত জ্ঞান দিয়ে আমার সম্প্রদায়ের জন্য, “ব্যাক হোম” (বাংলাদেশ)-এর জন্য কিছু করতে পারব বলে আশা রাখি।’
এমন কথার সূত্র ধরেই জানতে চাইলাম ‘ব্যাক হোম’-এর সঙ্গে কাশীফ নিজেকে কতটা সম্পৃক্ত মনে করে? জবাব, ‘দাদা সমুজ মিয়া কামালী থেকেই আমার নামে “কামালী” যুক্ত হয়েছে। যুক্তরাজ্যে জন্ম হলেও এ দেশটিকে দ্বিতীয় আবাস (সেকেন্ড হোম) মনে হয়।’ বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক দাতব্য কাজ করার আছে। কাশীফ বলে, ‘চামড়ার রং, আর্থিক অবস্থা কিংবা পারিবারিক পরিচয় কোনো কিছুই জীবনে বাধা হতে পারে না। এ বার্তাটিই আমি সবার কাছে পৌঁছে দিতে চাই। কারণ, আমার ইটনে ভর্তির সুযোগ এ সত্যটিই প্রমাণ করেছে।’

ইটন কলেজের কিছু তথ্য
ব্রিটিশ রাজা ষষ্ঠ হেনরি ১৪৪০ সালে ইটন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। লন্ডনের অদূরে বার্কশায়ারে উইন্ডসর দুর্গের কাছেই এর অবস্থান। এখানে মূলত ‘ইয়ার সেভেন’ (সপ্তম শ্রেণি) থেকে ‘এ লেভেল’ (উচ্চমাধ্যমিক) পর্যন্ত পড়ানো হয়। শুধু ছেলেরাই এখানে পড়াশোনা করে। এটি একটি আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২৫টি সুবিশাল বাড়িতে শিক্ষার্থীদের রাখা হয়। বর্তমানে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৩০০। প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা কক্ষ। প্রতি বাড়িতে একজন হাউস মাস্টার, দুজন ডেপুটি হাউস মাস্টার ও সহকারী কর্মী রয়েছে। আছে গৃহকর্মী। নির্ধারিত বিশাল খাবারঘরে চলে নিয়মতান্ত্রিক ভোজ। কঠোর শৃঙ্খলায় রাখা এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, সংগীত চর্চাসহ যেকোনো বিষয়ে মেধাবিকাশের সুযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা যাতে প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগাতে পারে, সে জন্য আছে সার্বক্ষণিক পরামর্শের ব্যবস্থা। এ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ফি প্রায় ৩৬ লাখ টাকা। এটা শুধু মৌলিক খরচ। বাড়তি প্রশিক্ষণ বা সেবার জন্য গুনতে হয় অতিরিক্ত অর্থ।
২০০২ সালে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ভর্তি নীতিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। মেধাবীরা যাতে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, সে জন্য ২০ শতাংশ ‘অ্যাসিসটেড প্লেস’ বা বৃত্তিপ্রাপ্ত আসন চালু করে। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ২৭৩ জন শিক্ষার্থী গড়ে ৬৬ শতাংশ কম বেতনে পড়েছে। আর ৭৩ জন শিক্ষার্থী পড়ছে সম্পূর্ণ বিনা বেতনে।
-সুত্র প্রথম আলো