আত্নহত্যার আগে চিরকুটে যা লিখে গেলেন জ্যাকলিন মিথিলা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ৩:৪৯ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
রাজধানীর বনশ্রীতে তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটের এক রুমে সাবলেট থাকতেন জ্যাকলিন মিথিলা। সেখানে বুধবার রাত কথা হয় তার বাবা-মার সাথে। মেয়ের আত্মহত্যার পিছনে স্বামী উৎপল রায়ের চেয়ে তার মা, বড় ভাইয়ের বউ, বোন ও দূর সম্পর্কের এক মামাকে দায়ী করেছেন। আর মিথিলার সুইসাইড নোটে তিনি লেখেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য উৎপলের পরিবার দায়ী।’
মিথিলার মা তাপসী শীল বলেন, উৎপল হচ্ছে আমার খালাতো বোনের দূর সম্পর্কের দেবর। মিথিলা তখন এইট-নাইনে পড়ে। এক আত্মীয়ের বিয়েতে তার সাথে আমার মেয়ের পরিচয় হয়। তখন সে কীভাবে জানি আমার মেয়ের কাছ থেকে ফোন নম্বর চেয়ে নিয়ে নেয়।
উৎপল তাকে ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে মা ডাকতে চাইলে তিনি আপত্তি জানান। পরে একদিন মেয়ের কাছে শোনেন তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক হয়েছে ওই বিয়ে অনুষ্ঠানের পর থেকে। একমাত্র সন্তান হওয়ায় তিনি তা মেনে নেনও।
তিনি আরও বলেন, কিছুদিন আগে উৎপলের মায়ের হার্টের অপারেশন হয় ভারতে। এ জন্য মিথিলা পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিল তাকে।
কিন্তু বিয়ে কবে হয়েছে? মিথিলার বাবা স্বপন শীল জানালেন গত ৩ নভেম্বর মিথিলা ও উৎপল কোর্ট ম্যারেজ করে। প্রথমে মিথিলার মা তাকে বিষয়টি জানতে দেয়নি। পরে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নেন তারা।
বিয়ের পর থেকে মিথিলাকে মেনে নেয়নি উৎপলের পরিবার। স্বপন শীল জানান, মিথিলাকে যাতে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেনে নেয় সেজন্য ছেলের পরিবারকে দাওয়াত করে খাইয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, আমি গরিব মানুষ। তারপরও প্রায় ১০-১২ হাজার টাকা খরচ করে তাদের পরিবারের মানুষকে দাওয়াত করে খাইয়েছিলাম। তারা সেখানে আমাকে অপমান করে চলে যায়। এটা ২০ নভেম্বর ২০১৬ সালের ঘটনা।
স্বপন শীল জানালেন বিয়ের কিছুদিন পর তার মেয়ে গর্ভধারণ করেন। কিন্তু ‘গর্ভবতী থাকলে কীভাবে উঠিয়ে নিব? অনুষ্ঠানইবা কীভাবে করব, লোকে কী বলবে।’— স্বামীর এমন প্ররোচণায় গর্ভপাত করান মিথিলা।
জ্যাকলিন মিথিলার মিডিয়ায় কাজ করা নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে সমস্যা করেনি। সমস্যা ছিল পারিবারিক মর্যাদা নিয়ে। তার শাশুড়ি মিনাক্ষী মহাজন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। আর মিথিলার বাবা ছিলেন পেশায় একজন নাপিত। এ নিয়ে স্বামীর বাড়ীর লোকজন তাকে কথাও শোনাত। ছেলের বড় ভাইয়ের বউ রূপা তাকে বলেছিলেন, কত টাকা লাগবে বল, আমার দেবরের জীবন থেকে সরে দাঁড়াও। জবাবে মিথিলা বলেছিল, আমি কি রাস্তার মেয়ে আমাকে টাকা দিয়ে কিনতে চান?— বলছিলেন স্বপন শীল।
তাপসী শীল ও স্বপন শীল দুজনেই জানালেন তারা দুজনেই আত্মহত্যার আগে মেয়ের ফেসবুকের স্ট্যাটাস সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। বনশ্রীর বাসায় উপস্থিত মিথিলার বান্ধবী সুইটি গত এক দেড় মাস ধরে নেটে ঢুকেন না বলে জানালেন। অন্যদিকে আরেক বান্ধবী কনা বলেন, আমার স্বামী একজন পুলিশ। সে দেখেছিল। কিন্তু পাত্তা দেয়নি। বলেছিল ও আগে যেভাবে বিভিন্ন কিছু করে ফোকাস হতে চেয়েছিল, এটাও হয়ত ওইরকম কিছু একটা হবে।
মা তাপসী শীল বলছিলেন, যেদিন মারা গিয়েছিল সেদিন ও সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে, সাধারণত আরো দেরি করে উঠত। আমাকে দিয়ে চালের রুটি বানায়। সবজি দিয়ে খায়। এমনকি চা-ও খায়, কিন্তু সে কখনো চা খেতো না। এরপর দেখি সে মুখে ক্রীম লাগাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম যেহেতু বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) তাহলে হয়ত স্বামীর সাথে দেখা করবে। কারণ বিয়ের পর সাধারণত তারা ওইদিন বেশি দেখা করত। কিন্তু কয়েক ঘন্টা হয়ে যাবার পরও সে দরজা খুলে না দেখে আমি ধাক্কাধাক্কি করি। পরে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখি তার পা ঝুলছে। আমি ওর বাবাকে খবর দিই।
তার বাবা জানালেন, তিনি এসে বাড়ির মালিককে খবর দিলে তিনি পুলিশকে খবর দিতে বলেন। পরে বন্দর থানার পুলিশ এসে লাশ নামায়।
তার মা জানালেন মেয়ে মিডিয়াতে কাজ করে এটা তারা প্রথমে জানতেন না। অনেকদিন পরে জেনেছিলেন। একমাত্র মেয়ে দেখে বাধা দিতে পারেননি। উৎপলের কারণে মেয়ে গত আট মাস ধরে মিডিয়াতে কোন কাজ করেনি, জানালেন মিথিলার মা।
মেয়ের লাশ নিজ হাতে নামান মা। তখনো মেয়ের মুখে সাদা ক্রীম। হয়ত মেয়ে স্বামী বা তার বাড়ীর লোকজনের সাথে ফোনে কথা বলার পরেই ফাঁস নেয়।
আত্মহত্যার আগে গত ২০ জানুয়ারি মিথিলা চট্টগ্রামের বাসায় যান। সেখানে ইস্পাহানি মোড়ের কালী বাড়ি রোডের রঞ্জিত ভবনে মা-বাবাকে ১১ হাজার টাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিয়েছিলেন।
মিথিলার বাবা বাদী হয়ে শ্বশুরবাড়ীর আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এরা হলেন— ১। উৎপল রায় (স্বামী) ২। মিনাক্ষী মহাজন (শাশুড়ী) ৩। কাজল ৪। সম্ভু ৫। রূপা ৬। পংকজ ৭। বাদল ও ৮। দিপক
এদিকে হাতে মিথিলার সুইসাইড নোট এসে পৌঁছেছে। সেখানে তিনি এদের নাম লিখে গেছেন। স্বামীকে উদ্দেশ্য করে লেখা নোটে তিনি লিখেন, আমার মৃত্যুর জন্য উৎপলের পরিবার দায়ী। তবে স্বামীকে অনেক ভালোবাসেন কিন্তু সাত বছরের সম্পর্কে বিয়ের পর স্বামী বদলে গেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। সুইসাইড নোটে মিথিলা লেখেন, রুপা বউদি আমাকে ফোন করে বলেছে যত টাকা লাগে আমাকে দিবে, তার বিনিময়ে তোমাকে ছেড়ে দিতে। উনি আমাকে রাস্তার মেয়ে ভেবেছে। এরচেয়ে বড় অপমান একটা মেয়ের পক্ষে কী হতে পারে? পংকজ নামের লোকটা আমার বাবাকে বলেছে, এ মেয়ে বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়া ভাল। তোমাকে যখন আমি বলেছি এই সপ্তাহে তুমি যদি দেখা না করো, তাহলে আমি আত্মহত্যা করব। তুমি বলেছো তোমার যা মন চায় করতে। তাই তো আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম।
সপ্তাহখানেক ধরে মিথিলার ফেসবুক আইডি আক্টিভ দেখানো নিয়ে বলেন, পুলিশের কাছে ওর দুটা ফোন জব্দ ছিল। ওরা গতকাল (মঙ্গলবার) একটা ফোন ফেরত দিয়েছে। ওখানেই হয়ত ফেসবুক অন করা ছিল।
মিথিলা চট্টগ্রামের শ্যামলী আইডিয়াল থেকে এসএসসিতে ৪.৮৯ পান। রাজধানী খিলগাঁও মডেল কলেজ থেকে এবার এইচএসসি দেবার কথা ছিল। প্রথমে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু নিয়মিত ক্লাস করতে সমস্যা হওয়ায় খিলগাঁও মডেলে চলে যান।
এদিকে মিথিলার আয়েই তার পুরো পরিবার চলত। বাবাকে কথা দিয়েছিল, একটি ভিআইপি সেলুন করে দিবেন। মাকে কিছুদিন আগে একটি ফ্রিজ কিনে দিয়েছিলেন। তার মা বিলাপের সুরে বলেছিলেন, আমার মেয়ে তাকে একটা বাজে কথাও কেউ বললেও আমার কাছে এসে বলত। কিন্তু আমি যদি জানতাম সে এমন করবে তাহলে তাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম, ছাড়তাম না। এখন যেমন চার-পাঁচদিন না খেয়ে আছি, তখন সে ঠান্ডা না হওয়া পর্যন্ত না খেয়ে পাহারা দিতাম।