সিলেটজুড়ে ইউরোপ যাওয়ার ফাঁদ : হাজারো তরুণের স্বপ্নের মৃত্যু, হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ নভেম্বর ২০১৬, ২:৫৩ অপরাহ্ণ
চৌধুরী মুমতাজ আহমদঃ
বিমানে করে লিবিয়া। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হবে সমুদ্র উপকূলে। সেখানে অপেক্ষায় আছে ট্রলার। ব্যস, তুলে দিলেই এক যাত্রায় পৌঁছে যাবেন ইতালি। এভাবেই বিদেশ ভ্রমণেচ্ছুদের চোখে-মুখে স্বপ্ন এঁকে দিচ্ছে মানবপাচারকারীরা। তারা গোপন রাখছে ভূমধ্যসাগরের বিপদসংকুল ট্রলারযাত্রার গল্পটি-যেখানে প্রতি মুহূর্তেই মৃত্যুর হাতছানি। তার উপর পুরো প্রক্রিয়াটি অবৈধ হওয়ায় যেকোনো সময় ধরা পড়ে জেলে যাওয়ার ভয় তো রয়েছেই। সিলেটে পাচারকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে লাখ লাখ টাকা দিয়ে এভাবেই ‘মৃত্যুদণ্ড’, ‘কারাদণ্ড’ কিনছেন জীবনের স্বপ্ন হারিয়ে ভাগ্যবদলের স্বপ্নে বিভোর যুবকরা।
সিলেটে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে মানবপাচারকারী চক্র। বিভিন্ন ট্রাভেলসের নামে অবৈধ পথে মানবপাচারের ব্যবসা সাজিয়ে কেবলই নিজেদের পকেট ভারী করে তুলছে। তাদের পাতা ফাঁদে সর্বস্ব হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন অনেকেই। কেবল মানবপাচারেই সীমাবদ্ধ নয় চক্রটির কর্মকাণ্ড, জিম্মি করে অর্থও হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। আর তাই অনেকেই আছেন জীবন হারানোর শঙ্কায়।
মানবপাচারে সিলেটের শক্ত সিন্ডিকেটটি নজরে আসে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে অবৈধভাবে লিবিয়াগামী ৩৯ জনকে আটকের পর। ১৩ই অক্টোবর র্যাবের হাতে আটক হওয়া এই ৩৯ জনের বেশির ভাগই সিলেটের বাসিন্দা। তখন র্যাব-৯ জানিয়েছিলো তারা মানবপাচারে পেছনের হোতা হিসেবে সিলেটের আল মামুন ট্র্যাভেলস এবং শামীম ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলসের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। শামীম ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী আদনান আনসারী ও মামুন ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মো. মামুনসহ মানবপাচারকারী হিসেবে যে ৩০ জনের নাম পায় র্যাব এর মধ্যে ১৭ জনই সিলেটের। আদনান ও মামুন ছাড়া অন্যরা হলেন- মো. লিলু, মতিউর রহমান, সাইদুর রহমান, তফুর আলী, মো. ইউছুফ, আজিজুল হক শাহীন, মো. শাজিন, নাসির, মো. আজাদ, রুমেন, শাহীন, মো. কামাল, মো. ফারুক, বতুল মেম্বার ও কাদের।
এ দুই ট্র্যাভেলস ছাড়াও সিলেটের অসংখ্য ট্র্যাভেলসের বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত নগরীর অলিগলিতে গড়ে ওঠা লাইসেন্সবিহীন ট্র্যাভেলসগুলোই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ ট্র্যাভেলস এজেন্সি সমিতির সিলেটের সভাপতি আবদুল জব্বার জলিল মানবজমিনকে জানান, সিলেটের ট্র্যাভেলস এজেন্সিগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই কোনো লাইসেন্সই নেই। তিনি তথ্য দেন, আল মামুন ট্র্যাভেলস এবং শামীম ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলসেরও কোনো ধরনের লাইসেন্স নেই। ভুয়া ও অবৈধ ট্র্যাভেলস এজেন্সির কারণে তাদের দুর্নাম হচ্ছে জানিয়ে আবদুল জলিল বলেন, বেশ আগে তারা ১০০টি অবৈধ ট্র্যাভেলস এজেন্সির তালিকা তৈরি করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়েও পাঠিয়েছিলেন।
র্যাবের অভিযানে চট্টগ্রামে আটক হওয়াদের মধ্যে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার ফাহিম আহমদ ইতালি পৌঁছে দেয়ার শর্তে দালালদের হাতে পাঁচ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন। একই লক্ষ্যে গোলাপগঞ্জ উপজেলার আবদুল মোমিন আট লাখ টাকা চুক্তি করেছিলেন দালালদের সঙ্গে। সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার মোহাম্মদ লিটন ৪ লাখ ২০ হাজার টাকায় দালালদের সঙ্গে রফা করেছিলেন, তারও উদ্দেশ্য ছিল লিবিয়া হয়ে ইতালিতে পাড়ি জমানো। লিটনের কাছে পাওয়া লাইফ জ্যাকেট থেকে র্যাবের ধারণা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার জন্য তিনি ‘প্রস্তুতি’ই নিয়ে এসেছিলেন।
বিভিন্ন ট্র্যাভেলস এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও ভুক্তভোগীরা তেমন প্রতিকার পাচ্ছেন না। সম্প্রতি
মানবপাচারের অভিযোগে সিলেটের আল হারামাইন ট্র্যাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন দক্ষিণ সুরমার আলমপুরের বাসিন্দা আবদুল মান্নান। পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে তার ছোটভাই মুমিনুল এখন রাশিয়ায় পাচারকারীদের হাতে জিম্মি। মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল সিলেটে দায়ের করা মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, আল হারামাইন ট্র্যাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের স্বত্বাধিকারী ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ১৪ লাখ টাকায় মুমিনুল হককে স্লোভেনিয়া পাঠানোর চুক্তি হয়। টাকা পরিশোধের পরও ট্রাভেলস কর্তৃপক্ষ তাকে বিদেশ পাঠানোর কোনো উদ্যোগ না নিলে আবদুল মান্নান টাকা ফেরত চান। তখন মুমিনুল হককে তারা রাশিয়া হয়ে ফিনল্যান্ড পাঠানোর প্রস্তাব দেন। রাশিয়া পাঠানোর কথা বলে তাকে ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা নিয়ে যায়। পরে আবদুল মান্নান তার ভাইয়ের আর কোনো খোঁজ পাননি। ভাইয়ের কোনো খোঁজ না পেয়ে ট্র্যাভেলস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে টের পান তারা পাচারকারীর খপ্পরে পড়েছেন। তখন আবদুল মান্নান টাকাসহ তার ভাইকে ফিরিয়ে দিতে চাপ দেন ট্র্যাভেলস কর্তৃপক্ষকে। তারা ৮ লাখ টাকার দুটি চেক প্রদান করে। এবং আগস্টের মধ্যেই বাকি টাকাসহ মুমিনুল হককে ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু টাকা না থাকায় চেক দুটি ব্যাংক থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। ভাইকেও ফেরত পাননি আবদুল মান্নান। ১৫ই সেপ্টেম্বর তিনি আবার হারামাইন ট্র্যাভেলসে যান। টাকাসহ ভাইকে ফেরত চান। এবার উল্টো সুর শুনান ট্র্যাভেলস কর্তৃপক্ষ। মুমিনুল হককে ফিরিয়ে দিতে তারা এবার ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন।
র্যাব-৯ এর মিডিয়া অফিসার এএসপি মোহাম্মদ জিয়াউল হক মানবজমিনকে বলেন, মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত অব্যাহত হয়েছে। ৪টি ট্র্যাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ট্র্যাভেল এজেন্সিসহ বেশকিছু আইএলটিএস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের নজরে রয়েছে। র্যাবের এ কর্মকর্তা তথ্য দেন, মানবপাচারের মূল হোতাদের তিনজনকে ইতিমধ্যে তারা শনাক্ত করতে পেরেছেন, আরো ৬/৭ জন তাদের নজরে রয়েছেন। যেকোনো সময় এদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে। সূত্র : মানবজমিন