সিলেটে ১০ টাকার চাল বিক্রিতে দুর্নীতি : হতদরিদ্রদের চাল যাচ্ছে স্বচ্ছলদের ঘরে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ অক্টোবর ২০১৬, ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর আওয়াত হতদরিদ্রদের মাঝে ১০ টাকার মূল্যের চা বিক্রয় কর্মসূচীতে সিলেটে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। দরিদ্রদের মধ্যে চাল বিতরণের জন্য এই কর্মসূচী গ্রহণ করা হলেও অনেকক্ষেত্রেই অবস্থাসম্পন্ন লোকেরা চাল পাচ্ছেন। অথচ বঞ্চিত হচ্ছেন দরিদ্ররা।
অপরদিকে, চাল আত্মসাত এবং সরকারী চাল অন্যত্র বিক্রি করে দরিদ্ররে মধ্যে নিম্মমানের চাল বিক্রির অভিযোগ ওঠেছে ডিলারদের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে সিলেটে এ পর্যন্ত অন্তত ৯ ডিলাররের ডিলারশিপ বাতিল করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক ডিলারকে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে সিলেট সদর উপজেলার বটেশ্বর বাজারের এক ব্যবসায়ীর গুদাম থেকে ৮৭ বস্তা চাল উদ্ধার করেছে পুলিশ। এগুলো সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর চাল। উদ্ধারকৃত চালের পরিমান উদ্ধারকৃত চালের পরিমান ৪ হাজার ৩৫০ কেজি বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ওই গুদামটি আব্দুল ওয়াদুদ নামে স্থানীয় এক চাল ব্যবসায়ীর জানিয়ে সিলেট শাহপরান থানার সহকারী কমিশনার সাজ্জাদুল আলম জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে আব্দুল ওয়াদুদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তবে কিভাবে তার গুদামে সরকারী চাল এলো এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিষিয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
সিলেট খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই কর্মসূচীর আওতায় পল্লী রেশনিং কার্ডের মাধ্যমে সিলেট জেলার ৫২ হাজার ৩৩০টি পরিবারকে ১০টাকা কেজি ধরে চাল প্রদান করা হচ্ছে।
সিলেট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ. রিয়াজুর রহমান রাজু জানান, ২০১১ সালে প্রতিটি ইউনিয়নের কমিটি করে হতদরিদ্রদের প্রাথমিক একটি তালিকা তৈরি করা হয়। এরপর উপজেলা কমিটি এটি যাচাই বাছাই করে চূড়ান্ত তালিকা করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরাকারী চাল বিক্রিতে অনিয়মের শুরু হয় ২০১১ সালে তালিকা তৈরির সময়ই। তৎকালীর ইউনিয়ন পরিশষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা নিজেদের আত্মীয়স্বজন আর ঘনিষ্টজনদের এই তালিকায় অন্তর্র্ভূক্ত করেন। যাদের বেশিরভাগই স্বচ্ছল। অনেক পরিবারে একাধিক ব্যক্তিকেও কার্ড প্রদান করা হয়। এমনকি তৎকালীন ইউপি সদস্যরা নিজেদের পরিবারকেও এই তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করেন।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুচাই ইউনিয়নের এই কর্মসূচীর এক ডিলার বলেন, চাল বিক্রির সময় আমার কাছে অনেকেই এসে অভিযোগ করেন তারা হতদরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও চাল পাচ্ছেন না। আবার তাদের প্রতিবেশী অনেক স্বচ্ছল পরিবারও চাল পাচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে তাদের বক্তব্যের সত্যতাও পেয়েছি। কিন্তু তালিকা তো আমি করিনি। আর তালিকার বাইরে কাউকে চাল প্রদানের সুযোগ আমার নেই।
এমন অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন এই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও। দক্ষিণ সুরমার ইউএনও শাহেদ মোস্তফা বলেন, তালিকাটি তৈরি করেছিলেন আগের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা। তারা অনেকক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি করেছেন। আমি এখনকার চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বলেছি, তালিকা নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে, সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন হলে আমার কাছে পাঠাতে।
দরিদ্রদের বদলে স্বচ্ছলরা চাল প্রাপ্তির তালিকায় ঢুকে পড়ার অভিযোগ আছে সিলেট সদর উপজেলায়ও। এই উপজেলার ইউএনও মীর মো মাহবুবুর রহমান বলেন, তালিকাটি করা হয়েছে ২০১১ সালে। এই পাঁচ বছরে অনেক দরিদ্রও স্বচ্ছল হয়ে গেছে। আবার তালিকার অনেকে মারা গেছে। ফলে নতুন করে কিছু লোককে অর্ন্তভূক্ত করতে হচ্ছে। এতে কিছুটা অনিয়ম হচ্ছে। তবে তা খুব বড় কিছু নয়। তাছাড়া প্রথম কিছু শুরু করলেও সামান্য সমস্যা তো হয়ই।
অনিয়মের অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান এই ইউএনও।
এতো গেলো তালিকা তৈরিতে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। অভিযোগ আছে ডিলারদের বিরুদ্ধেও।
খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট কমিটি প্রতি ৫০০ পরিবারের জন্য একজন করে ডিলার নিয়োগ দিয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্ত এই ডিলাররা সাড়ে ৮ টাকা কেজি দরে চাল সংগ্রহ করে ১০ টাকা দরে কার্ড প্রাপ্তদের হাতে বছরে ৫ মাস চাল বিতরণ করবেন। প্রতি মাসে প্রত্যেক পরিবারকে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে।
তবে অভিযোগ রয়েছে, অনেক ডিলার খাদ্য গুদাম থেকে ভালো মান চাল এনে তা বাইরে বিক্রি করে দেন। আর কার্ড প্রাপ্তদের কাছে বিক্রি করেন নিম্মমানের চাল। এছাড়া অনেক ডিলারদের বিরুদ্ধে চাল আত্মাসাত করে ফেলা ও ওজনে কম দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে।
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার চাল দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের আব্দুল কাদির মোল্লা ও আজিজুর রহমান দুই ডিলারের বিরুদ্ধে সরকারী চাল আত্মসাতের অভিযোগ তুলে এলাকাবাসী। এলাকাবাসীর অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করতে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সাহাব উদ্দিনকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও অনিয়মের অভিযোগ তুলে এলাকাবাসী। তাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলনও শুরু করে এলাকার লোকজন।
অবশেষে বৃহস্পতিবার আব্দুল কাদির মোল্লা ও আজিজুর রহমানের ডিলারশিপ বাতিল করা হয় ও খাদ্য নিয়ন্ত্রক সাহাব উদ্দিনকে তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এই তথ্য নিশ্চিত করে ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান জানান, তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরোদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অনিয়মের কারণে দক্ষিণ সুরমার কুচাই ইউনিয়নের ডিলার সালাউদ্দিন রিমনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নিন্মমানের চাল বিক্রির অভিযোগে গত ১১ অক্টোবর তাকে আটক করা হয়। এসময় তার কাছ থেকে প্রায় ৩ হাজার ৪ শত ১০ কেজি নিন্মমানের চাল জব্দ করা হয়। পরে তার ডিলাশীপও বাতিল করা হয়। একই উপজেলার লালাবাজার ইউপির ডিলার রাকিব আহমদকেও অনিয়মের অভিযোগ গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এছাড়া শনিবার বিকেলে বড়লেখার উপজেলায় চাল ওজনে কম দেওয়ার অপরাধে দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের মুড়াউল বাজারের ডিলার নাছির উদ্দিনকে ৩ হাজার টাকা ও দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নের কাঁঠালতলী বাজারের আব্দুর রহিমকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম আব্দুল্লাহ আল মামুন এই জরিমানার আদেশ দেন।
এদিকে, ১০ টাকার মূল্যের চাল বিক্রিতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে বিষয়টি মনিটরিং করতে দুটি ভিজেলেন্স টিম গঠন ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন। বৃহস্পতিবার এ দুটি টিম গঠন করা হয় বলে জানান ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার হুরে জান্নাত।
এসব অভিযোগের বিষয়ে সিলেট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ. রিয়াজুর রহমান রাজু বলেন, কিছু কিছু অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ পেলে সাথেসাথেই খোঁজা নেওয়া হচ্ছে। অনিয়ম পেলে পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে।