প্রবাসী বাংলাদেশিদের অন্যতম গন্তব্য এখন আমেরিকার মিশিগান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ আগস্ট ২০১৬, ১২:৫৭ অপরাহ্ণ
প্রবাস ডেস্ক:
ডেট্রয়েট মেলায় সমবেত বাংলাদেশি উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের অন্যতম গন্তব্য এখন মিশিগান। শত বছর আগে বাংলাদেশ থেকে জাহাজে করে অজানার পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন একদল পূর্বসূরি। তাদের পদচিহ্ন দেখেই যেন মিশিগান রাজ্যে স্বদেশিদের অভিবাসন প্রবাহ আজও অব্যাহত রয়েছে। ১৭০১ সালে ফরাসি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে এ রাজ্যের ডেট্রয়েট নগরীর গোড়াপত্তন ঘটেছিল। সময়ের ব্যবধানে ডেট্রয়েট নগরী বিশ্বের মোটর সিটি নামে খ্যাতি লাভ করে। আমেরিকার বিশ্বজুড়ে যে দাপট, তার অন্যতম উপাদান তাদের মোটরযান। বিশ্বের প্রধান মোটর উৎপাদনের এ নগরীতে বাংলাদেশিদের জড়িয়ে পড়ার ইতিহাসও শত বছরের। একসময় নেহাত শ্রমিক হিসেবে পূর্বসূরিদের কেউ কেউ কাজ করেছিলেন। এখন মিশিগানের মোটরযান শিল্পে কাজ করছেন বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা দাপটের সঙ্গে। অগ্রসর পেশাজীবীদের দাপুটে এ কাজের সঙ্গে নিত্যদিন যোগ দিচ্ছেন সাধারণ সব প্রবাসীরা। সাধারণজনের অসাধারণ কর্মপ্রয়াসে একটি বিপন্ন নগরী ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। মিশিগানের জনকোলাহলে বাংলাদেশিরাই হয়ে উঠছেন গুরুত্বপূর্ণ এক অভিবাসী গোষ্ঠী।
ডেট্রয়েটে বাংলাদেশ অ্যাভিনিউআমেরিকার সাম্প্রতিক মন্দা অর্থনীতির সময়ে মোটরযান শিল্পে হঠাৎ ধস নামে। জাপান ও কোরিয়ার মোটরযানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছিল না আমেরিকায় উৎপাদিত পণ্য। গত এক শ বছরে বিশ্বে দাপট দেখানো শিল্প দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়ে উঠলে এক ধরনের ভীতি দেখা যায় আমেরিকার সর্বত্র। গাড়ি নির্মাণের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে তাদের কারখানা বন্ধ করতে থাকে। লোক ছাঁটাই করে উৎপাদন সংকুচিত করতে বাধ্য হয়। ডেট্রয়েট মেট্রো এলাকা নামে পরিচিত পুরো বসতি গড়ে উঠেছে যন্ত্রযান শিল্পের কর্মকোলাহল নিয়ে। আচমকা মন্দায় পড়ার পর আতঙ্ক দেখা দেয়। লোকজন নগরী ছেড়ে যেন পালিয়ে বাঁচেন। ডেট্রয়েট মেট্রো এলাকার বহু বসতি এলাকায় লোকজন বাড়ি ফেলে অন্যত্র চলে যান। বিশাল আমেরিকার অভিবাসন বসতির স্বাভাবিক নিয়মে লোকজন মন্দা দেখা রাজ্য ছেড়ে চলে যান সম্ভাবনা আছে এমন সব অঙ্গরাজ্যে। একধরনের অনন্যোপায় হয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা।
এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মোটরযান শিল্পের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ২০০০ সাল থেকে পতনের দিকে যাওয়া মোটরযান শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে থাকে ২০১২ সালের দিকে। ২০১০ সালের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ডেট্রয়েট মেট্রো এলাকার ৬০ শতাংশ মানুষ স্থানান্তরিত হয়ে গেছেন। নগরী এক বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। সারি সারি বড়ি ঘর খালি পড়ে থাকে। পতনের পর উঠে দাঁড়াতে সময় লাগে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে বহু ঐতিহ্যের নগরী ডেট্রয়েটে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বড় একটি নগরী নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। এমন চরম সংকটেও অসম সাহস নিয়ে টিকে থাকেন আমাদের লড়াকু প্রবাসীরা।
মেট্রো ডেট্রয়েট এলাকায় বসবাসরত প্রবাসী হেলাল উদ্দিন রানা এ প্রতিবেদককে জানান, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সংকট ছিল চরমে। একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছিল। এমনিতেই বাংলাদেশি অভিবাসীদের অধিকাংশ কাজ করেন অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে। কর্মসংস্থান সংকুচিত হলেও অনেকটা মাটি কামড়ে সুদিনের প্রত্যাশায় টিকে থাকতে হয় বলে তিনি বলেন। দুই দশক থেকে ডেট্রয়েট প্রবাসী মিজান চৌধুরী বলেন, অন্য অভিবাসীদের মতো আমাদের বিকল্প চিন্তার অবকাশ ছিল না। একদিকে অন্যরা রাজ্য ত্যাগ করেছে, অপরদিকে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসীদের আগমন অব্যাহত থাকে।
ডেট্রয়েটে বাংলাদেশি মসজিদ পেশাজীবী ছাড়া ডেট্রয়েট মেট্রো এলাকায় বসবাসরত অধিকাংশ প্রবাসীই এসেছেন পারিবারিক অভিবাসনে। ডিভি ভিসা, ওপি ওয়ান ভিসায় আসা প্রথম দফা অভিবাসীদের পারিবারিক অভিবাসন অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশিদের অভিবাসনের প্রথম পছন্দের নগরী নিউইয়র্ক। নিউইয়র্ক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য নগরীতে প্রথম আসা অভিবাসীদের উপার্জনের সিংহ ভাগ চলে যায় বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে। নিউইয়র্কে এক বেডরুমের বাসায় মাথা গোঁজার জন্য কষতে হয় কমপক্ষে মাসে ১২০০ ডলার। ডেট্রয়েট নগরীতে মন্দা দেখা দিলে লোকজন তিন বেডরুমের বাসা ভাড়া পেয়েছেন মাসে ৫০০ ডলারে। নিউইয়র্কে তিন চার লাখ ডলারের নিচে বাড়ি কেনার কথা চিন্তা করার সুযোগ নেই। সেখানে ২০ হাজার ডলার দিয়েও মিশিগানে বাড়ির মালিক হয়েছেন অনেক প্রবাসী।
লোকজনের ফেলে যাওয়া বাড়ি অনেকে নিলামে কিনেছেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিনেছেন পানির দামে। ব্যবসায়ী শামীম আহমেদ জানালেন, বাংলাদেশিরা নিজেদের তাগিদেই গড়ে তুলেছেন নানা সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অন্যান্য অভিবাসী গোষ্ঠী ডেট্রয়েট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে কর্মী সংকট দেখা যায়। ধীরে ধীরে যখন অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরে দাঁড়াতে থাকে, তখন অদক্ষ প্রবাসীরা সহজেই কাজ পেয়েছেন।
ডেট্রয়েট মেট্রো এলাকায় ঠিক কত বাংলাদেশ আছেন, এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। প্রবাসীরা বলেন, এ সংখ্যা ২৫ হাজার হবে। আবুল কাশেম নামের এক যন্ত্রযান কর্মী প্রবাসী মনে করেন, ডেট্রয়েট মেট্রো এলাকায় বাংলাদেশির সংখ্যা ৩৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন পারিবারিক অভিবাসনে বাংলাদেশিদের আগমন অব্যাহত রয়েছে এ নগরীতে। এ ছাড়া নিউইয়র্কসহ অন্যান্য রাজ্য থেকে জীবনযাত্রা সহজ হওয়ায় অনেকেই স্থানান্তরিত হচ্ছেন মিশিগানে। নিউইয়র্কে আট বছর বসবাস করে সম্প্রতি মিশিগানে স্থানান্তর করেছেন আতিকুর রহমান। জানালেন, আট বছর রেস্টুরেন্টে কাজ করে সব উপার্জন দিয়েছেন বাসা ভাড়ার পেছন। আতিক জানালেন, মিশিগানে আয় রোজগার কম হলেও ঘর ভাড়া ও জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক কম। ফলে নিম্ন আয়ের লোকজনও একটি স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনের সুযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্রের এ নগরীতে।
ডেট্রয়েট মেলায় সংগীতানুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করছেন একজন শিল্পীচল্লিশ বছরের বেশি সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন নিজাম উদ্দিন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে প্রবাসী হয়েছিলেন। ছাত্রাবস্থায় একাত্তর সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আমেরিকার রাজপথে মিছিল করেছেন। প্রায় তিন দশক থেকে মিশিগানে থাকেন নিজাম উদ্দিন। এ প্রতিবেদককে জানালেন, শান্ত অভিবাসী হিসেবে মিশিগানে বাংলাদেশির সুনাম রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে নিজেদের বর্তমান আধিপত্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, এ সবই হয়েছে খুব সাধারণ গ্রাম থেকে আসা সাধারণ অভিবাসীদের মাধ্যমে। হ্যামট্রামিক আর ডেট্রয়েট নগরীর কন্যান্ট অ্যাভিনিউয়ের নামকরণ করা হয়েছে বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ নামে। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ এখন পুরোপুরি প্রবাসীদের দখলে। দুপাশে সারি সারি সব দোকানপাটে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড। লুঙ্গি-চপ্পল পরে অনেকটা দেশের আয়েশি ভঙ্গিতে বাজার করতে দেখা যায় শান্ত এ নগরীতে বসবাসরত প্রবাসীদের। সড়ক পথ বন্ধ করে প্রবাসীরা মেলা করছেন। সড়কের দুপাশে ঝালমুড়ি থেকে পানের দোকানের পসরা বসিয়ে দেশের মেলার স্বাদ নিতে দেখা গেল দূর দেশে থাকা এসব প্রবাসীদের। মঞ্চে চলছে ভাওয়াইয়া আর বাউল করিমের গান। হাজারো প্রবাসী নারী-পুরুষ মধ্যরাত পেরিয়েও গান শুনছেন। প্রবাসী শুক্লা রানি জানালেন, দেশেও কোনো দিন কোনো নগরকেন্দ্রে এমন করে খোলা মঞ্চে গানের আসর উপভোগ করেননি। মিশিগানে বসবাস করে বাংলাদেশকে আর দূরে মনে হয় না বলে জানালেন গাড়ির কারখানায় কাজ করা এ প্রবাসী নারী।
ডেট্রয়েটপ্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিনপ্রায় সব বাড়ির আঙিনায় বাংলাদেশি লাউ ও শিমের চাষ। ডেট্রয়েট নগরীতে স্কুলশিক্ষক হিসেবে কাজ করে অবসরে গিয়েছেন শাহ খালিশ মিনার। লুঙ্গি পরে নিজের বাড়ির আঙিনায় ফল আর সবজির চাষ দেখালেন। তিন দশক থেকে এ নগরীতে বসবাস করা শাহ মিনার জানালেন, তিনি যখন স্কুল শিক্ষকতা শুরু করেন তখন মিশিগানে বাংলাদেশিদের খুব বেশি অভিবাসন ঘটেনি। গত দুই দশকে দ্রুত বাড়ছে ও সম্ভাবনাময়য় এ নগরীতে বাংলাদেশিদের আরও অভিবাসন ঘটবে বলে তিনি মনে করেন। ইতিমধ্যে নগর প্রশাসনেও বাংলাদেশিদের সম্পৃক্ততা ঘটেছে, নির্বাচনে বাংলাদেশিদের ভোট হারা জেতার জন্য মুখ্য হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ থেকে সদ্য এসেছেন ব্যবসায়ী লায়েছুর রহমান। জানালেন, পরিবার নিয়ে অভিবাসী হয়েছেন। সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য পরিবারকে মিশিগানেই রেখে দেবেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের চিন্তাও শুরু করেছেন দেশ থেকে আসা এ সদ্য প্রবাসী। স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় বহু প্রবাসীর স্বপ্ন ভঙ্গের করুণ কাহিনি শুনতে হয়। মিশিগানে বসবাসরত আমাদের প্রবাসীদের উদ্যোগ আর প্রত্যয়ে ভিন্ন বাস্তবতা। কর্মচঞ্চল সাধারণ এ প্রবাসীরা রাজ্যের সীমিত সুযোগ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলছেন নিজেদের ভবিষ্যৎ। বিদেশের মাটিতে গড়ে তুলছেন নিজেদের শক্ত ভীত।
আমেরিকার প্রথম তালিকাভুক্ত টেলিফোন গ্রাহক বসবাস করতেন ডেট্রয়েট নগরীতে। ১৮৭৯ সালে আমেরিকার প্রথম তালিকাভুক্ত টেলিফোন গ্রাহকের এ নগরী নানা কারণেই বিখ্যাত। অর্থনৈতিক চাঞ্চল্যে ডেট্রয়েট নগরী আবার দাপট ফিরে পেলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নামও উচ্চারিত হবে আগামী দিনে এ নগরীর ইতিহাস পাঠে।