রাগীব আলীর জালিয়াতিতে অনেকেই দিশেহারা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ আগস্ট ২০১৬, ২:০৫ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজ :
অসংখ্য নিরপরাধ ও নিরীহ মানুষদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেলেন শিল্পপতি রাগীব আলী। সিলেট পাইলট স্কুলের ছাত্রাবাস, তারাপুর চা-বাগান, ঢাকার গুলশানের ৭০ কোটি টাকা মূল্যের বাড়ী। এসবই জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাস করেছেন রাগীব আলী। ভূসম্পত্তি আত্মসাতের একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত রাগীব আলী সৃষ্ট অনেক বিষয় এখন অনেকের জীবন মরণ সমস্যায় দাঁড়িয়েছে।
নিজের অনুসারীদের কাছে রাগীব আলী পরিচিত ছিলেন ‘দানবীর’ নামে। বহুব্যবহারের কারণে তার নামের আগে এ বিশেষণ প্রায় স্থায়ী রূপ পেয়েছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের কারণেও আলোচনায় ছিলেন রাগীব আলী। সিলেট বিভাগে রাগীব আলী ও তার স্ত্রীর নামে রয়েছে অর্ধশতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শুধু দানবীরই নয়, রাগীব আলীর নামের আগে ‘সৈয়দ’, ‘ক্রীড়া পৃষ্ঠপোষক’, ‘শিক্ষানুরাগী’, ‘মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক’সহ ব্যবহার হয় আরো নানা বিশেষণ।
রাগীব আলীর ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার কামালবাজার এলাকার তালেবপুর গ্রামের বাসিন্দা রাগীব আলী তরুণ বয়সেই যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। সেখানে প্রচুর সম্পদের অধিকারী হয়ে আশির দশকের গোড়ার দিকে দেশে ফিরে আসেন তিনি। শিল্পে বিনিয়োগে উদ্যোগী হয়ে এ সময় তিনি সিলেটের মালনীছড়াসহ একাধিক চা-বাগান ইজারা নেন।
সিলেটে রাগীব আলী প্রথম আলোচনায় আসেন ১৯৮২-৮৩ সালের দিকে। সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রাবাস ‘ক্রয় করে’ তোপের মুখে পড়েন তিনি। সিলেট নগরীর প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র বন্দরবাজারে এক হিন্দু জমিদারের দান করা জমিতে এ ছাত্রাবাস নির্মাণ করেছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রাগীব আলী এ ছাত্রাবাস কিনে নিয়েছেন, এমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সে সময় সিলেটজুড়ে শুরু হয় ছাত্রাবাস রক্ষা আন্দোলন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৮৬ সালে ছাত্রাবাসের জায়গায় রাগীব আলী ‘মধুবন’ নামে একটি বিপণিবিতান স্থাপন করেন, যা এখনো রয়েছে।
দীর্ঘকাল ধরে চলা মামলার রায়ে বলা হয়, রাগীব আলী প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে তারাপুর চা-বাগান দখল করেছেন। এ বাগান দেবোত্তর সম্পত্তিটির সেবায়েতকে ফিরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি এতে নির্মিত সব স্থাপনা অপসারণেরও নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে বাগানের ক্ষতি করার দায়ে রাগীব আলীর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়েরও নির্দেশ দেয়া হয়।
এর আগে ২০০৯ সালে রাগীব আলীর কাছ থেকে এ দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধারের সুপারিশ করে তত্কালীন সংসদীয় কমিটি। এছাড়া এ বাগানের জায়গায় গড়ে তোলা রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম পরিবর্তন ও তা ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনার সুপারিশ করা হয়।
সংসদীয় কমিটির ওই প্রতিবেদন মতে, ১৯১৫ সালের ২ জুলাই বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্ত তার সিলেট নগরীর পাঠানটুলা এলাকার তারাপুর চা-বাগানসহ সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউর নামে দানপত্র করেন। তখন থেকে সম্পত্তিটি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত। সর্বশেষ বৈকুণ্ঠ চন্দ্র গুপ্তের নাতি পঙ্কজ কুমার গুপ্ত এ বাগানের সেবায়েতের দায়িত্ব পান। পঙ্কজ ভারত চলে গেলে কথিত পাওয়ার অব অ্যাটর্নিমূলে সম্পত্তিটির সেবায়েত বনে যান রাগীব আলীর আত্মীয় দেওয়ান মোস্তাক মজিদ। অহিন্দু ব্যক্তিকে দেবোত্তর সম্পত্তির সেবায়েত করায় সে সময়ই বিষয়টি আলোচনায় আসে। পরবর্তীতে মোস্তাক মজিদ এ বাগানের ইজারা ৯৯ বছরের জন্য রাগীব আলীর ছেলে আবদুল হাইকে দেন। এক্ষেত্রেও নেয়া হয় জালিয়াতির আশ্রয়। এক্ষেত্রে ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং ভূঃ মঃ/শা-৮/খাজব ৫৩/৮৯-এ মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মির্জা ফজলুল করিমের স্বাক্ষর জাল করা হয়।
এদিকে এ ভূসম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তৎকালীন সিলেট সদর ভূমি কমিশনার এসএম আবদুল হাই কোতোয়ালি থানায় এ মামলা (নং-১১৭/০৫) করেন। দীর্ঘদিন স্থগিত থাকার পর আদালতের নির্দেশে পুনরায় মামলাটির কার্যক্রম শুরু হয় সম্প্রতি। বুধবার এ মামলায় রাগীব আলী, তার ছেলেমেয়েসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
পরোয়ানা জারির পরই গ্রেফতার এড়াতে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাড়ি দেন রাগীব আলী। তার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের সহকারী পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) সুজ্ঞান চাকমা।
কেবল সিলেটেই নয়, রাজধানীর গুলশানেও ২২ কাঠা জমির একটি বাড়ি জাল দলিলের মাধ্যমে দখল করে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে রাগীব আলীর বিরুদ্ধে। অগ্রণী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা গুলশানের ওই বাড়ি ৭০ কোটি টাকায় বিক্রি করেন তিনি। গুলশানের ৩৬ নম্বর রোডের ৩৩ নম্বর বাড়ির ওই জমির মূল মালিক এআরএ জুট ট্রেডিং করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানটির নেয়া ঋণের বিপরীতে অগ্রণী ব্যাংকের কাছে জমিটি বন্ধক রয়েছে। ২০০৪ সালে ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকায় জমিটি বিক্রির জন্য রাগীব আলীর সঙ্গে চুক্তি করে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এতে আপত্তি জানিয়ে অগ্রণী ব্যাংক রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা করে। ওই মামলায় সর্বোচ্চ আদালত থেকে বলা হয়, জমির দলিলটাই জাল ছিল। আর এ কাজও করেছেন রাগীব আলী।