প্রতিশোধের মরণখেলা সিলেটের খুলিয়াটুলায়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ আগস্ট ২০১৬, ১:১১ পূর্বাহ্ণ
চৌধুরী মুমতাজ আহমদঃ
প্রতিশোধের মরণখেলায় যেন মেতেছে সিলেট মহানগরীর খুলিয়াটুলার দুটি পক্ষ। একটি বিরোধের বলি হয়ে পাল্টাপাল্টি হামলায় ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন। এক চোখ হারিয়ে জীবন্মৃত হয়ে আছেন আরো একজন। দেড় বছরে তাদের বিরোধে কয়েকবারই খুলিয়াটুলার পথ রক্তাক্ত হয়েছে। সর্বশেষ এ বিরোধের নির্মম বলি হন সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর শাহানা বেগম শানুর স্বামী তাজুল ইসলাম।
বিরোধের শুরু কিন্তু দেড় বছরে নয়। অনেক পেছনে এর শেকড়। শাহানা বেগম শানু কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকেই তাজুল-শানুর পরিবারটি এলাকায় দাপুটে একটি পরিবার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য এর ভিত্তি আগেই গড়ে তুলেছিলেন স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা তাজুল ইসলাম নিজেই। ছাত্রদলের কর্মী পরিচয়ে যখন তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু তখন থেকে এলাকায় একটা পরিচিতিও পেয়ে যান তাজুল ইসলাম। চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে সে পরিচয় তাকে এলাকায় দাপট দেখানোর মতো শক্তিও এনে দেয়। সিলেট নগরীর তালতলা, শেখঘাট, কুয়ারপার, লামাবাজার জুড়ে এক নামেই পরিচিতি পেয়ে যান তাজুল। এরপর সরকার পাল্টালেও দাপটের ঘাটতি পরেনি তাজুল ইসলামের। ২০০৮ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৩, ১৪ ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ড মিলিয়ে নারীদের জন্য সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তার স্ত্রী শাহানা বেগম শানু। ব্যক্তির পরিবর্তে খুলিয়াটুলায় শুরু হয় একটি পরিবারের দাপট।
তাজুল-শানুর দাপট মোকাবিলায় এলাকায় তাদের প্রতিপক্ষ গড়ে উঠে তখন থেকেই। প্রকাশ্যে-গোপনে অনেকেই তাদের বিরোধিতা করতে থাকেন। ছাত্রদল নেতা ও স্থানীয় নীলিমা সমাজ কল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কামাল আহমদ প্রকাশ্যেই শানুর বিপক্ষে অবস্থান নেন। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত পরবর্তী নির্বাচনে শানুর প্রতিদ্বন্দ্বী দিবা রানী দে বাবলীর হয়ে প্রচারণায় নামেন কামাল। নির্বাচনে জয়ীও হন বাবলী। নীলিমা-২৩ নম্বর বাসার মৃত সুরুজ আলীর ছেলে কামালের উপর তাই খেপে উঠেন শানু ও তার পরিবার। কামালের সঙ্গে আগে থেকেই দ্বন্দ্ব ছিল শানু ও তার পরিবারের। শুধু কামাল নয় কামালের পরিবারের সঙ্গে জায়গা-জমির দখল নিয়ে তাজুল-শানুদের অনেকদিনের পুরো বিরোধ ছিল। এমন অবস্থায় খুলিয়াটুলাস্থ শেখ নাসির আলী জামে মসজিদের নামে দেয়া কামাল আহমদের ১ শতক ভূমির মালিকানা দাবি করেন শানুর পরিবার। সব মিলিয়ে পাথর ব্যবসায়ী কামাল আহমদের ওপর ভীষণ রকম চটে ছিলেন তাজুল-শানু। প্রকাশ্যেই দেখে নেয়ার হুমকিও দেন কামালকে। ২০১৪ সালের ২৪শে জানুয়ারি খুলিয়াটুলা এলাকায় দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কামালের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। গুরুতর আহত অবস্থায় কামালকে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায়ই কামাল তাজুল ইসলাম, তার স্ত্রী শাহানা বেগম শানু, তাদের ছেলে রায়হান ইসলাম ও তাজুল ইসলামের ভাই নূরুল ইসলামসহ চার জনের নামোল্লেখ করে কোতোয়ালি থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন।
কামাল যখন হাসপাতালে তখন পাল্টা হামলার শিকার হন তাজুল ও শানুর ছোট ছেলে মদন মোহন কলেজের ছাত্র সোহান ইসলাম। ২৬শে জানুয়ারি প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে সোহানকে। এ ঘটনায় তাজুল-শানু অভিযুক্ত করেন কামালসহ তাদের প্রতিপক্ষদের। প্রতিশোধের শপথ নেয় শানুর পরিবার। নির্বিরোধী কলেজছাত্র সোহানের মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি এলাকার বাসিন্দারাও।
১৫ই সেপ্টেম্বর রাতে আবারো হামলার শিকার হন কামাল আহমদ। এবার আর বাঁচতে পারেননি তিনি। আশঙ্কাজনক অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক কামালকে মৃত ঘোষণা করেন।
কোনো পক্ষ বসে থাকেনি। পাল্টা আঘাত আসে ২০১৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর। তাজুল ইসলামের বড় ছেলে রায়হান ইসলামকে খুলিয়াটুলায় ‘গরম দেওয়ান’র মাজারের সামনে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে দুর্বৃত্তরা। তার চোখে ঢেলে দেয় চুন। সেই জখম নিয়ে রায়হান যখন ভারতের হাসপাতালে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন তখনই খবর যায় বাবার মৃত্যুর। মাকে নিয়ে আহত অবস্থায়ই দেশে ফিরে আসেন রায়হান।
খুনের নেশাই যেন পেয়েছে খুলিয়াটুলাকে। একের পর এক হত্যা। পাল্টাপাল্টি হামলা-হত্যা ঘটনা খুলিয়াটুলায় নতুন নয়। ২০০৭ সালে ফেনসিডিল ব্যবসা নিয়ে বিরোধের জেরে ফখরুল ইসলাম নামে তাজুল ইসলামের এক ভাই খুন হন। এরও আগে নজরুল ইসলাম নামে তাজুলের আরো এক ভাই খুন হয়েছিলেন। পাল্টাপাল্টি খুন, পাল্টাপাল্টি হামলা- যেন কেউ কাউকেই ছেড়ে কথা কইবে না। মামলা হোক, আরো হত্যা হোক, কেউ কিছু পরোয়া করে না। খুনের বদলে কেবলই খুনের ঘটনা ঘটে। বারবার রক্ত ঝরে ‘গরম দেওয়ান’র মাজারের সামনে। কেউ যদি শুধু কুপিয়ে খুন করে পাল্টা জবাবে কোপানোর পাশাপাশি চোখে চুন ঢেলে দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয় নৃশংসতার প্রতিযোগিতায় কেউই কারো চেয়ে কম নয়।-মানবজমিন