সিলেটে জামায়াত-জমিয়তের ঠাণ্ডা লড়াই
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ৬:১৪ অপরাহ্ণ

ওয়েছ খছরুঃ
কওমি ঘরানার আলেমদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ‘ঠাণ্ডা লড়াই’ বহু আগে থেকেই চলছে। অনেকের মতে, আকিদাগত এ লড়াই কখনো মিইয়ে যায় আবার সময় সময় চাঙ্গাও হয়। এবার নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিকে কেন্দ্র করে এ লড়াই চাঙ্গা হয়ে উঠছে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে বিরোধ এরই মধ্যে দানা বাঁধছে। তবে নীরব রয়েছেন জামায়াত প্রার্থীরা। উভয়পক্ষের কর্মী-সমর্থকরাও অবশ্য নেট দুনিয়ায় ঝড়-পাল্টা ঝড় তুলছেন। মাওলানা হেলাল আহমদ। সিলেট অঞ্চলের পরিচিত একজন আলেম। আল্লামা আব্দুল্লাহ হরিপুরী (রহ.)’র সন্তান। বর্তমানে মাদ্রাসাতুল উলুম দারুল হাদীস হরিপুর মাদ্রাসার মুহতামিম। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ঘরানার আলেম তিনি। গত বৃহস্পতিবার রাত তখন ১০টা। হরিপুর মাদ্রাসার বার্ষিক এনামী জলসা চলছিল। মাদ্রাসায় অবস্থান করছিলেন জমিয়ত মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি। বয়ানে জামায়াতে ইসলামীর ‘বিতর্কিত’ কর্মকাণ্ড নিয়ে বক্তব্য রাখছিলেন হেমু মাদ্রাসার মুহতামিম মুফতি জিল্লুর রহমান কাসেমী। তার বক্তব্যের শেষপর্যায়ে মাইক হাতে নেন মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা হেলাল আহমদ। একটি কথা বলতে চাই বলে তিনি তার বক্তব্য শুরু করেন। মাওলানা হেলাল বলেন, বর্তমানে যারা জামায়াতে ইসলামী করেন তারা একটা কথা কয়, যে কথা বলে আমাদের ধোঁকা দিতে চায়। তারা বলতে চায় যে, তারা মওদুদী সাহেবের জামায়াতে ইসলামী করে না।
আবার কেউ বলেন, মওদুদ সাবেক যেসব কথা বলেননি সেসব কথা এখন কওমি মাদ্রাসার আলেমরা বলেন। তিনি উপস্থিত জনতার কাছে জানতে চান- এ দু’টি কথা মিথ্যা না সত্য। তখন সমস্বরে সবাই বলে ওঠেন মিথ্যা। তাদের নেতাদের কথা প্রমাণ করে যে, মওদুদ সাহেব যেভাবে ইসলামের অপব্যাখ্যা করেছেন, সাহাবা কেরাম ও আম্বিয়া কেরামদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, দ্বীনদার তৌহিদী জনতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এই ভাবে বর্তমান নেতারাও কথা বলছেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, মওদুদী সাহেবের কথায় ও বর্তমান নেতাদের কথায় সমান কিনা। এ সময়ও মাহফিলে উপস্থিত থাকা জনতা ‘সমান’ বলে মন্তব্য করেন। পরে মাওলানা হেলাল আহমদ বলেন, জামায়াতে ইসলামী না-হক্ব, বাতিল, গুমরা। তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী যে কথা বলে গেছেন তা বাস্তব, ঠিক তাদের নেতাদের কথায় প্রমাণ হচ্ছে কিনা। তাহলে তারা মিথ্যুক, ধোঁকাবাজ। ইসলামের নাম নিয়ে তারা ধোঁকা দিতে চাচ্ছে। এ সময় তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আগামী নির্বাচনে একটি ভোট আপনারা পাল্লায় দেবেন কিনা। জবাবে জনতা ‘না’ সূচক মন্তব্য করেন। আপনাদের চাচা, ভাই যারা পাল্লায় ভোট দিতে চায় তাদের বিরত রাখতে হবে। বক্তব্যের শেষপর্যায়ে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নাম সম্পর্কে মওদুদী বলছে, এটা আমার বানানো ইসলাম। আমার পকেটে বানানো ইসলামের দল হলো এটা।
হেলাল আহমদ বলেন, এটা কোরআন হাদীসের ইসলামের দল নয়, নবীজির রেখে যাওয়া ইসলামের দল নয়, এটা মওদুদীর বানানো ইসলামের দল। তিনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, জামায়াতে ইসলামীর পাল্লা এটা ইসলামের পাল্লা না ঠগর (প্রতারক) পাল্লা। এ সময় জনতার তরফ থেকে উত্তর আসে ঠগর (প্রতারক) পাল্লা। মাওলানা হেলালও বলেন, এটা ঠগর পাল্লা, ইসলামের নামে ধোঁকা দেয়ার পাল্লা। হুঁশিয়ার হয়ে যাও- যারা এখনো বুঝতে পারছো না তারা লাথি খেয়ে এক সময় এই দেশ ছাড়তে হবে। তিনি বলেন, কয়েকজন মোল্লা রয়েছে যারা কওমি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছে আবার জামায়াতের রুকন হয়েছে। এ ধরনের আলেমকে বর্জন করে চলার পরামর্শ দেন তিনি। এদিকে, এনামী জলসায় দেয়া মাওলানা হেলাল আহমদের বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হওয়া মাত্র তোলপাড় শুরু হয়েছে। অনেকেই তার বক্তব্যের খণ্ড ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করেন। মুহূর্তে এসব ভিডিও ভাইরাল হয়। স্ট্যাটাসে পক্ষে-বিপক্ষের মন্তব্য সয়লাব হয়।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে সিলেট অঞ্চলের আলেম-ওলামাদের মধ্যে। তারা মাওলানা হেলাল আহমদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছেন, এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা হচ্ছে তা সবই উস্কানি। ভোটের মাধ্যমে জনগণ এই উস্কানির জবাব দেবে। এদিকে, বছর খানেক আগে দারুল উলুম কানাইঘাট মাদ্রাসায় একইভাবে জামায়াত সমর্থিত আলেম ‘হুদ মাওলানা’-কে নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন হরিপুর মাদ্রাসার মুহতামিম। তার বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উস্কানি শুরু হলে হরিপুরে বিশাল সমাবেশ করে এর জবাব দেয়া হয়েছিল। পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়ার আশঙ্কায় পরবর্তীতে সিলেটের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর হস্তক্ষেপে দরগাহে হযরত শাহ্জালাল (রহ.) মাদ্রাসায় বসে বিষয়টির মীমাংসা হয়। তবে হরিপুর মাদ্রাসার মুহতামিমের বৃহস্পতিবারের বক্তব্যকে এখনো অফিসিয়ালি আমলে নেয়নি জামায়াতে ইসলামী। গতকাল বিকালে জেলার এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি অফিসিয়ালি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে বলেছেন, সামনে নির্বাচন।
নির্বাচন কেন্দ্রিক অনেক বক্তব্য আসবে। সব আমলে নেয়া যায় না। মাওলানা হেলাল আহমদের বেয়াই এডভোকেট মোহাম্মদ আলী জমিয়ত প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন। তার বেয়াইয়ের পক্ষ নিয়ে হয়তো এ কথা বলেছেন। এটি জনগণ বিচার করবে। এ ছাড়া নির্বাচনের পর তো সবাই আবার একসঙ্গে বসবাস করতে হবে। এজন্য বক্তব্যের পাল্টা জবাব তারা দিতে চান না। এদিকে, জামায়াত নেতারা বক্তব্য না দিলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বক্তব্যের জবাব কঠোরভাবে দিচ্ছেন দলের কর্মী-সমর্থকরা। কেউ কেউ ভিজ্যুয়ালি এসে কঠোর মন্তব্য করছেন। হরিপুর মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা নেট দুনিয়ায় পাল্টা জবাব দিচ্ছেন। এতে করে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে তপ্ত হয়ে উঠার আভাস মিলছে। হরিপুরের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাদ্রাসার মুহতামিম তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য আলেম। তাকে কোনোভাবে বিতর্কিত বা আক্রান্ত করার চেষ্টা করা হলে তারা ভ্যানগার্ড হিসেবে পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত রয়েছেন।







