সিলেটের ইতিহাস মুছে যাচ্ছে হাতুড়ি শাবলের আঘাতে, ভাঙছে ‘মিনিস্টার বাড়ি’
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ৬:২৫ অপরাহ্ণ
সিলেট নগরের পাঠানটুলা এলাকার ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাক্ষী ‘মিনিস্টার বাড়ি’ ভাঙা শুরু হয়েছে। শতবর্ষী এই স্থাপনা একসময় ছিল প্রখ্যাত রাজনীতিক ও শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদের আবাসস্থল। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তানকাল পর্যন্ত রাজনৈতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে থাকা এই বাড়িটি এখন হাতুড়ি-শাবলের আঘাতে ভেঙে যাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বাড়িটি মাত্র ১৮ লাখ টাকায় এক ভাঙারি ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করা হয়েছে। ক্রেতাই বর্তমানে শ্রমিক দিয়ে ভবনটি ভাঙার কাজ করছেন।
তবে শুক্রবার সকালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের গবেষণা সহকারী মো. ওমর ফারুক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং রবিবার পর্যন্ত ভাঙার কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। এ সময় পরিবেশকর্মী ও স্থপতিরা উপস্থিত ছিলেন।
ঐতিহ্যের ধারক ‘মিনিস্টার বাড়ি’
আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ আব্দুল হামিদ এ বাড়িটি নির্মাণ করেন।তিনি ব্রিটিশ ভারতের আসাম ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ও শিক্ষা মন্ত্রী ছিলেন। এরপর ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। তার কারণেই এই বাড়িটি ‘মিনিস্টার বাড়ি’ নামে পরিচিত।
তবে এই বাড়িটি কবে নির্মিত হয়েছিলো তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কেউ কেউ বাড়িটির বয়স শতবর্ষ বলে জানিয়েছেন। তবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আব্দুল হামিদ ১৯৬৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
আব্দুল হামিদ ছিলেন তৎকালীন আসামের এমএলএ এবং বৃহত্তর আসামের শিক্ষামন্ত্রী। তিনি তৎকালীন বিধানসভার স্পিকারও ছিলেন। পরবর্তীতে দেশ ভাগের পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকারে শিক্ষামন্ত্রী ও বিভিন্ন সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
স্থানীয়দের ধারণা, বাড়িটির বয়স প্রায় এক শতাব্দী হলেও নির্দিষ্টভাবে নির্মাণ সাল জানা যায়নি। বাড়িটির ওপরের ছাদ ও দেয়ালে ফাটল ধরায় মালিকপক্ষ এটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।
পরিবারের দাবি ও স্থানীয় ক্ষোভ
আব্দুল হামিদের নাতি আনিসুল ইসলাম জানান, “বাড়িটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। আমাদেরও কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু নিরুপায় হয়ে ভাঙতে হচ্ছে।”
অন্যদিকে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক আক্ষেপ দেখা দিয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ভূমিসন্তান বাংলাদেশ’ এর সমন্বয়ক আশরাফুল কবির বলেন, “এই বাড়িটি কেবল একটি স্থাপনা নয়, সিলেটের ইতিহাসের অংশ। এটি সংরক্ষণ করে জাদুঘর বানানো যেতো।”
স্থপতি রাজন দাশ বলেন, “এখনও সময় আছে—ভবনটি সংরক্ষণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চলছে।”
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
বাড়িটিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ তৎকালীন বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব অবস্থান করেছেন। স্থাপনাটিতে ছিল ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব—খিলান আকৃতির দরজা, কাঠের জানালা ও মেঝেতে পুরনো মোজাইক।
আব্দুল হামিদের বোন ছিলেন হাফিজা বানু, যিনি ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের দাদী। অর্থাৎ, এই বাড়িটি শুধু স্থাপত্য নয়—একটি রাজনৈতিক ও পারিবারিক ঐতিহ্যের কেন্দ্রও ছিল।








