বিএনপি-এনসিপি জোট গঠনের আলোচনা, আসন নিয়ে চলছে দর-কষাকষি
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ

সুরমা নিউজ ডেস্কঃ
জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর রাজনীতিতে নতুন করে মেরূকরণ শুরু হয়েছে। কারণ এই সনদ স্বাক্ষরকে কেন্দ্র করে জামায়াতের ওপরে ক্ষুব্ধ হতে শুরু করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জানা গেছে, দলটি ইতোমধ্যে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনি জোট করার জন্য তৎপর হতে শুরু করেছে। পর্দার আড়ালে এখন চলছে আলোচনা। কতটি আসনে এনসিপিকে ‘ছাড়’ দেওয়া হবে- সে নিয়েই চলছে বিএনপির সঙ্গে দর-কষাকষি।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ থেকে জন্ম নেওয়া ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ বা আপ বাংলাদেশের সঙ্গে একই মঞ্চে উঠছে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)। এই দুই সংগঠনের উদ্যোগে আগামী ২৩ অক্টোবর রাজধানীর তোপখানা রোডের একটি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আলোচনা সভা। সভায় অতিথি হিসেবে থাকছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. বদিউল আলম মজুমদার, আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট হাসান কাইয়ূম, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, আপ বাংলাদেশের সদস্যসচিব আরেফিন মুহাম্মদ হিজবুল্লাহ প্রমুখ। এতে সভাপতিত্ব করবেন এবি পার্টি চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। সঞ্চালনা করবেন আপ বাংলাদেশের মুখপাত্র শাহরিন সুলতানা ইরা।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এটিও শেষ পর্যন্ত একটি রাজনৈতিক মঞ্চে রূপ নিতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর জামায়াতের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে এনসিপি। একই সঙ্গে দলটি পর্দার আড়ালে বিএনপির সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। গত রবিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতার বাসায় এনসিপির একটি প্রতিনিধিদল বৈঠক করে। বৈঠক শেষে তারা নৈশভোজে মিলিত হন। সূত্রের দাবি, ভবিষ্যৎ নির্বাচনি জোটের বিষয়ে ওই সময় অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। সূত্রমতে, পর্দার আড়ালে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গেও এ বিষয়ে দফায় দফায় আলোচনা চলছে।
সূত্রটি জানায়, এখন পর্যন্ত ৮ থেকে ১০টি আসন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা চলছে এনসিপির। দলটি ২০টিরও বেশি আসন চাইলেও বিএনপি সাত থেকে আটটির বেশি ছাড়তে রাজি হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, বিএনপির সঙ্গে এনসিপির জোট গঠনের উদ্যোগের এই বিষয়টি জামায়াতও অবগত। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা খবরের কাগজের কাছে স্বীকার করেন, এনসিপির সঙ্গে বিএনপির জোট গঠনের তৎপরতা সম্পর্কে তারা জানেন। ওই নেতা জানান, রবিবার জামায়াত সম্পর্কে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের অবস্থান দেখেই তারা বুঝতে পারছেন, কিছু একটা হচ্ছে।
জানতে চাইলে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার খবরের কাগজকে বলেন, আগামী নির্বাচনে করণীয় বিষয়ে আপাতত কৌশল প্রণয়নের কাজ চলছে। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন দলের সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়ে নানাভাবে আলোচনা হচ্ছে। তবে এটি এখনো চূড়ান্ত কিছু নয়।
জামায়াত-এনসিপি টানাপোড়েন
একসময় একই লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন করা জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সম্পর্কে এখন টানাপোড়েন চলছে। সংসদ নির্বাচন, ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে অবস্থান, ‘শাপলা প্রতীক’ এবং ‘পিআর’ ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দলের মধ্যে তীব্র ভিন্নমত দেখা দিয়েছে। উভয় পক্ষই এখন একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দ্বিচারিতা ও দলীয় স্বার্থে কাজ করার অভিযোগ তুলছে।
প্রতীকের রাজনীতিতে উত্তেজনা
দলের প্রতীক হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কাছে ‘শাপলা’ দাবি করে আসছে এনসিপি, কিন্তু ইসি এখনো সেই প্রতীক দলটিকে দেয়নি। কমিশন জানিয়েছে, শাপলা বাদে বাকি ৫০টি প্রতীকের মধ্য থেকে একটি বেছে নিতে হবে দলটিকে। এর পেছনে জামায়াতের ইন্ধন দেখছে এনসিপি। দলটির নেতাদের অভিযোগ, ‘শাপলা প্রতীক না দেওয়ার পেছনে বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতেরও যোগসাজশ রয়েছে।’
এনসিপির এক মুখপাত্র খবরের কাগজকে বলেন, ‘ক্ষমতা পরিবর্তনের পর নির্বাচন কমিশনে বিএনপি-জামায়াতপন্থি কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছেন। এখন তারা নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। আমাদের কাছে খবর আছে, এনসিপি যেন শাপলা প্রতীক না পায়, সে ক্ষেত্রে জামায়াতও বাধা সৃষ্টি করছে।’ তিনি আরও বলেন, জামায়াতের রাজনীতিতে একমত না হলে তারা অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে। এটিই তাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের আচরণে আমরা পক্ষপাতিত্ব লক্ষ করছি। ইসি এখন ধর্মভিত্তিক দলের প্রভাবে পরিচালিত হচ্ছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সেই প্রভাব রয়েছে। শাপলা প্রতীক ইস্যুতে কমিশন একধরনের গোয়ার্তুমি করছে, যা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।’
জুলাই সনদে দ্বন্দ্বের বিস্তার
জামায়াত ও এনসিপির টানাপোড়েন আরও প্রকট হয়ে ওঠে জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান ঘিরে। দুই দল আগে থেকেই আইনি ভিত্তি ছাড়া জুলাই সনদে স্বাক্ষরে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে একমত ছিল। এনসিপি জামায়াতকে অনুরোধ করেছিল, আইনি ভিত্তি না পেলে তারা যেন সনদে স্বাক্ষর না করে। এ উদ্দেশ্যে এনসিপির প্রতিনিধিদল জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের ও হামিদুর রহমান আযাদের সঙ্গে বৈঠকও করে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জামায়াত অবস্থান বদলে সনদে স্বাক্ষর করে। এতে এনসিপি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় এবং সনদে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে।
দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম রবিবার নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) আন্দোলন, যা জামায়াত শুরু করেছিল, সেটি ছিল এক পরিকল্পিত রাজনৈতিক চাতুরী। ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়া বানচাল করতেই এটি করা হয়েছে।’
তিনি আরও লেখেন, ‘আমরা জনগণের গণ-অভ্যুত্থানের আলোকে সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাঠামো তৈরি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জামায়াত সেটিকে দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার বানিয়েছে।’
নাহিদ ইসলামের অভিযোগ, জামায়াত কখনোই সংস্কারের কোনো কার্যকর প্রস্তাব দেয়নি কিংবা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি আন্তরিকতা দেখায়নি। বরং তারা সংস্কারবাদের ছদ্মবেশে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করেছে।
ঐকমত্য কমিশনের ভিন্ন অবস্থান
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাতেও দুই দলের অবস্থান বিপরীতমুখী। এনসিপি অভিযোগ করেছে, জামায়াত কমিশনকে নিজেদের রাজনৈতিক সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে। সামান্তা শারমিন বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনকে আমরা পরিবর্তনের একটি নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জামায়াত সেটিকে তাদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে।’ তিনি আরও বলেন, উচ্চকক্ষে পিআর বাস্তবায়নের কথা বললেও পরে তারা নিম্নকক্ষে অবস্থান নেয়। কখনো স্বাক্ষর না করার ঘোষণা দিয়েছে, আবার পরে স্বাক্ষরও করেছে। তাদের অবস্থান অস্পষ্ট এবং রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ঠিক নেই।
এনসিপির মুখপাত্র ও মিডিয়া সেল সম্পাদক মুশফিক উস সালেহীন বলেন, জামায়াত বলেছিল, আইনি ভিত্তি ছাড়া তারা সনদে স্বাক্ষর করবে না। কিন্তু তারা করেছে। এটা রাজনৈতিক দ্বিচারিতা ছাড়া কিছু নয়। তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপি ও জামায়াত রাষ্ট্র পুনর্গঠনের চিন্তা বাদ দিয়ে ক্ষমতা ভাগাভাগির রাজনীতি করছে। তারা জনগণের আন্দোলনকে নিজেদের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত করেছে। আইনি ভিত্তিহীন জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেও তারা সেটিকে সাফল্য হিসেবে প্রচার করছে।







