সিলেটবাসীর আরেক স্বপ্নের অপমৃত্যু
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১৭ অপরাহ্ণ

সুরমা নিউজ ডেস্কঃ
সিলেট বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার- এমন অভিযোগে সিলেটে যখন আন্দোলন-আলটিমেটাম চলছে এমন সময়ে আরেক দু:সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। সুরমার উপর স্বপ্নের ঝুলন্ত ব্রিজ হচ্ছে না। নতুন পরিকল্পনা হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ কীন ব্রিজ ঘিরে। এতে সিলেটের সর্বস্তরে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
এক সময় কীন ব্রিজই ছিল সুরমা পারাপার তথা যোগাযোগের প্রাণ। এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। ভারি যান চলাচলের অযোগ্য এক স্মৃতিস্মারক। দীর্ঘদিন ধরে সিলেটবাসী স্বপ্ন দেখছিলেন কীন ব্রিজের পাশে একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণে; যা হবে আধুনিক সৌন্দর্যের প্রতীক। এটা নগরীর যানজট কমাবে, আর সিলেটের পর্যটনে যোগ করবে নতুন মাত্রা। কিন্তু সেই স্বপ্নও শেষ পর্যন্ত হার মানল প্রশাসনিক অজুহাতের কাছে।
বিদেশি সংস্থা ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)’ ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়ে সেতুটি নির্মাণে সম্মতি দিলেও, ‘অ্যাপ্রোচ সড়কের জায়গা নেই’ এই যুক্তিতে প্রকল্পটি বাতিল করে দিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এনডিবি কর্মকর্তারা সেতুর সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শন, নদীর নাব্যতা ও পানিপ্রবাহের জরিপ সম্পন্ন করলেও ৫ আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর প্রকল্পের অগ্রগতি থমকে যায়।
পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, সুরমার দুই পাড়ে জায়গা সংকট থাকায় ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়; ফলে নতুন সেতুর পরিবর্তে পুরনো কীন ব্রিজের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে তিন টন পর্যন্ত যানবাহন চলাচলের সক্ষমতা থাকলেও সেটি আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সওজ।
সওজ জানিয়েছে, কীন ব্রিজের পুরনো কাঠামো সংরক্ষণ ও পুনর্নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। ব্রিজটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর সীমিত যান চলাচল অব্যাহত থাকবে।
সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আমীর হোসেন জানান, ঝুলন্ত সেতুর জন্য অনেক লম্বা অ্যাপ্রোচ সড়কের প্রয়োজন। উভয়প্রান্তে প্রয়োজনীয় পরিমাণ জায়গা নেই। তাই এই সেতু নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না। এর পরিবর্তে কীন ব্রিজের সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
কিন্তু উন্নয়নপ্রত্যাশী সিলেটবাসীর প্রশ্ন- শতবর্ষী এক জীর্ণ সেতুর ‘সক্ষমতা বৃদ্ধি’ কী আধুনিক নগরীর প্রয়োজন মেটাতে পারবে? প্রশাসনের নীতিনির্ধারণে স্বপ্নের জায়গায় যখন যুক্তি হয় সীমাবদ্ধতা, তখন সিলেটবাসী আরেকবার শুনছে পরিচিত শব্দ ‘প্রকল্প বাতিল’।
এ ঘোষণায় সিলেটজুড়ে ক্ষোভ ও হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের ব্যবসায়ী, নাগরিক সংগঠন, ট্যুর অপারেটর থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ বলছেন, আরেকটি উন্নয়ন স্বপ্নও কাগজেই শেষ হলো।
জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, সিলেটবাসীর সব বঞ্চনা, বৈষম্য একই সুতোয় গাঁথা। সিলেটবাসী জাগছে, সব দাবিই আদায় হবে।
টোয়াসের সাধারণ সম্পাদক শেখ রাফি বলেন, লোহার লাল কীন ব্রিজের পাশে একটি ঝুলন্ত সেতু হলে সিলেটের সৌন্দর্য নতুনভাবে ফুটে উঠতো, দেশ-বিদেশের পর্যটক আকৃষ্ট হতো, নগরীতে নতুন অর্থনৈতিক প্রাণ ফিরে আসতো। অথচ সেই সম্ভাবনা এখন মরে গেছে ফাইলের ভেতর।
সিলেট সোসাইটির উপদেষ্টা ডা. জহির অচিনপুরী প্রশ্ন রাখেন- সিলেটের উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্প গোপনে বাতিল করা হবে কেন? এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের গণমাধ্যমের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা থেকে থাকলে বিষয়টি নিয়ে সিলেটের নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে বৈঠকে বসতে হবে। অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদাসীনতা, স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিরুদ্ধাচরণের মাধ্যমে সিলেটবাসীকে দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, এর পরিণতি শুভ নয়।
সিটিজেন রাইটস লইয়ার্স এলায়েন্সের কনভেনর অ্যাডভোকেট মঈনূল হক বুলবুল বলেন, সিলেটবাসী নিজেদের হিস্যার ব্যাপারে উদাসীন বলেই, অন্যরাও উদাসীনতা প্রদর্শন করে চলেছেন। উদাসীনতায় তদ্রাগত সিলেটবাসী ক্রমেই জেগে উঠছেন। বেশি দেরি নেই, সব হিস্যার কথা উঠে আসবে, সেদিন বেশি দূরে নেই।
সচেতন মহলের অভিযোগ, একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পে সিলেটের বঞ্চনা যেন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। কখনো বিমানবন্দর উন্নয়ন আটকে যায়, কখনো রেললাইন ডাবলিং প্রকল্পে স্থবিরতা, আবার কখনো বন্দর ও হাওর উন্নয়ন প্রকল্পও হারিয়ে যায় রাজনৈতিক টানাপড়েনে। এখন ঝুলন্ত সেতু প্রকল্প বাতিল হয়ে সেই হতাশায় যুক্ত হয়েছে নতুন অধ্যায়।
সাম্প্রতিক সিলেট উন্নয়ন আন্দোলনের নেতারাও বলছেন, সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বারবার সিলেট উপেক্ষিত হচ্ছে। তারা মনে করিয়ে দিয়েছেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, রেলপথ, বিমানবন্দর ও পর্যটন অবকাঠামোতে বৈষম্য দূর না হলে সিলেটের প্রবাসনির্ভর অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে টিকবে না। সুত্র-যুগান্তর







