দলীয় মনোনয়নে তারেক রহমানের নতুন মেসেজ—’পেশি নয় জনসমর্থনই চূড়ান্ত মাপকাঠি’
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ৩:১৬ অপরাহ্ণ
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক নতুন সোপানে দাঁড়িয়ে। আগামী জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক মাঠে উত্তাপ ততই বাড়ছে। কিন্তু এই উত্তাপে এক নতুন সুর তুলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলের মনোনয়ন বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক মন্তব্য শুধু একটি কৌশলগত ঘোষণা নয়—এটি বাংলাদেশের দলীয় রাজনীতির সংস্কারধারায় এক সম্ভাব্য নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান যখন বললেন, “আমরা এমন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেব, যার প্রতি এলাকার মানুষের প্রকৃত সমর্থন আছে, যিনি জনগণের সমস্যার সাথে যুক্ত,”—তখন অনেকেই সেটিকে কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হিসেবে নিলেও, গভীর পর্যবেক্ষকরা দেখছেন এর মধ্যে এক নীরব বিপ্লবের ইঙ্গিত।
বহু বছর ধরেই দেশের নির্বাচনী রাজনীতি অভিযোগে ভারাক্রান্ত—টাকার প্রভাব, পেশিশক্তির দাপট, পারিবারিক বংশপরম্পরায় টিকিট পাওয়া, কিংবা রাজনৈতিক আনুগত্যের বিনিময়ে প্রার্থী মনোনয়ন—এসবই ছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতির অলিখিত নিয়ম। কিন্তু তারেক রহমানের বক্তব্যে উঠে এসেছে ভিন্ন এক বাস্তবতা:
“আমরা দলের নেতৃত্ব নয়, এমন মানুষ খুঁজছি যিনি দলমত নির্বিশেষে এলাকার মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন।”
এই বক্তব্য শুধু বিএনপির মনোনয়ন প্রক্রিয়া নয়, বরং দলীয় রাজনীতির ধারা নিয়ে এক মৌলিক প্রশ্ন তোলে—রাজনীতি কি কেবল দলের জন্য, নাকি জনগণের জন্য?
সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান আরও বলেন, “তৃণমূলের মতামত আমরা নিই, তবে গণতন্ত্রে সবসময় ভিন্নমত থাকবেই।”
এই মন্তব্যে তিনি যেন রাজনীতির এক প্রাচীন সত্যকে নতুন করে মনে করিয়ে দিলেন—গণতন্ত্র মানে ভিন্নতার মধ্যেই ঐক্য খোঁজা। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়: বাংলাদেশে তৃণমূলের কণ্ঠস্বর কি সত্যিই দলীয় মনোনয়নে প্রভাব ফেলে?
রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, অতীতে দলের সিদ্ধান্ত প্রায়ই কেন্দ্রীয় পর্যায়েই নেওয়া হয়েছে, যেখানে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের মতামত উপেক্ষিত থেকেছে। কিন্তু তারেক রহমানের এই ঘোষণার মধ্যে যে বার্তা রয়েছে, তা হলো “তৃণমূলের বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেওয়া”। তিনি বলছেন, মনোনয়নের মূল মাপকাঠি হবে এলাকার মানুষের সঙ্গে প্রার্থীর যোগসূত্র, গ্রহণযোগ্যতা এবং সমস্যাবোধ।
এই দৃষ্টিভঙ্গি যদি বাস্তবে রূপ পায়, তবে এটি হতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতির সংস্কারের এক কার্যকর সূচনা—যেখানে দলীয় পরিচয় নয়, জনগণের আস্থা হবে প্রার্থীতার ভিত্তি।
স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতি একসময় ছিল মানুষের জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। গ্রামের চায়ের দোকান থেকে শহরের ফুটপাথ পর্যন্ত রাজনীতি ছিল আলোচনার মূল কেন্দ্র। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি হয়ে উঠেছে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, সাধারণ মানুষের আস্থা সরে গেছে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে।
এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের বক্তব্য একরকম ‘হারানো ধারণার’ পুনর্জাগরণ—যেখানে তিনি বলছেন, প্রার্থী হতে হলে প্রথমে হতে হবে জনগণের প্রতিনিধি। শুধু দলের নয়, পুরো এলাকার মানুষ যেন মনে করে, “এই মানুষটিই আমাদের।”
এই দর্শনের ভিতর দিয়ে তিনি আসলে রাজনীতিকে পুনরায় জনগণের কণ্ঠে ফিরিয়ে আনতে চান—একটি রাজনীতি যেখানে নির্বাচনী টিকিটের মানদণ্ড হবে জনপ্রিয়তা নয়, বরং জনসংযোগ; অর্থ নয়, বরং আস্থা।
যদি সত্যিই বিএনপি এই নতুন নীতি বাস্তবায়ন করে, তাহলে এর প্রভাব হবে বহুস্তরীয়।
প্রথমত, দলীয় শৃঙ্খলায় আসতে পারে নতুন প্রাণ। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যদি দেখেন তাদের মতামত গুরুত্ব পাচ্ছে, তাহলে দলের ভিতরে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়বে।
দ্বিতীয়ত, জনগণের কাছে দলটির ভাবমূর্তি বদলাবে—বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে “প্রচলিত রাজনীতির ক্লান্তি” অনুভব করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি যদি সত্যিকার অর্থে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, তাহলে এটি ভবিষ্যতের নির্বাচনে তাদের জন্য এক বড় ইতিবাচক পার্থক্য তৈরি করতে পারে। কারণ জনগণের কাছে এখন সবচেয়ে মূল্যবান হলো বিশ্বাস—যা হারিয়ে গেছে রাজনৈতিক বিভাজনের ঝড়ে।
তবে বাস্তবতা কঠিন। বাংলাদেশে রাজনীতির অর্থনীতি আজ জটিল—মনোনয়ন মানে অনেক ক্ষেত্রেই আর্থিক প্রস্তুতি, প্রভাব বলয়, সামাজিক মর্যাদা। এই কাঠামো ভাঙা সহজ নয়।
তারেক রহমান যেই নীতির কথা বলছেন, সেটি বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে “দলের ভিতর থেকেই”। কারণ, যারা বহু বছর ধরে ক্ষমতার কেন্দ্র ঘিরে রাজনীতি করেছেন, তারা সহজে এই নতুন ধারাকে মেনে নেবেন না।
তবু ইতিহাস বলছে—রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে সাহসীদের হাত ধরেই। যদি বিএনপি সত্যিই এই পথে হাঁটে, তাহলে এটি বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
তারেক রহমানের এই নতুন বার্তাটি শুধু বিএনপির জন্য নয়—এটি একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের আহ্বান।
তিনি মূলত বলেছেন, “রাজনীতি হবে জনগণের জন্য, জনগণের অংশগ্রহণে।”
এই বার্তা যদি বাস্তবে রূপ পায়, তাহলে বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতির মুখ বদলাতে পারে।
একটি সত্য এখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে—নির্বাচন মানে কেবল ভোটের দিন নয়; এটি আসলে জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের পরীক্ষা। আর সেই পরীক্ষায় টিকতে হলে প্রয়োজন মানুষের আস্থা, যা অর্থ বা প্রভাব দিয়ে কেনা যায় না।
তারেক রহমানের এই বক্তব্যে সেই আলোয় ঝলমল করে উঠেছে এক নতুন সম্ভাবনা—যেখানে দল নয়, জনগণ হবে প্রার্থীর মাপকাঠি।
এই লেখা যখন লিখছি তারেক রহমানের বিবিসি বাংলাকে দেয়া এই সাক্ষাৎকারকে বাংলাদেশের আগামী রাষ্ট্রনায়কের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম। তাঁর পরিমিত বক্তব্য, আত্মবিশ্বাসী উপস্থাপন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতীয় বাংলা ভাষাভাষী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছ থেকেও ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। অনেকেই বলছেন, এই সাক্ষাৎকারে প্রকাশ পেয়েছে এক পরিণত, দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যদি সত্যিই এই চেতনা প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে হয়তো আমরা ফিরে পাব সেই রাজনীতি, যার উদ্দেশ্য ক্ষমতা নয়—মানুষের কল্যাণ।
মানবজমিন








