ওসমানীনগরে জনস্বাস্থ্যের অস্বাস্থ্যকর কারসাজি, কাজ শেষ না করেই টাকা উত্তোলন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুলাই ২০২৫, ১০:০০ অপরাহ্ণ
জুবেল আহমদ:
পিইডিপি-৪ এর আওতায় সারা দেশের ন্যায় সিলেটের ওসমানীনগরে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কার্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক ও ইম্প্রুভমেন্ট টয়লেট নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা ধরণের অসঙ্গতি, অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। কাজ শুরু না করে টাকা উত্তোলন, কাজ শেষ না করেই কাজ হস্তান্তর , নি¤œমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার, নির্মাণ কাজে ত্রুটি, দীর্ঘ দিন ধরে কাজ ফেলে রাখাসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে প্রকল্পের কাজে।
নামে মাত্র ঠিকাদার নিয়োগ করে কৌশলে নিজের হাতে রেখে প্রকল্পের কাজ করাচ্ছেন উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী। আর এই সুবাধে কাজ শুরু না করেই ইচ্ছে মতো অগ্রগতি দেখিয়ে উত্তোলন করে নেয়া হচ্ছে প্রকল্পের অর্থ । অনেক প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন না করেই অনুরোধের সুরে রীতিমতো চাপে রেখে প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কাছ থেকে কাজ হস্তান্তর নথিতে স্বাক্ষর করিয়ে নিচ্ছেন।
সিলেট জেলা জনস্বাস্থ্য কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পিইডিপি-৪ এর আওতায় ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য এই উপজেলায় ৪টি প্যাকেজে ৭ কোটি ৩৩ লাখ ৫ হাজার ৬১২ টাকার ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ পায় ৪ টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সোনালী সিন্ডিকেট (প্যাকেজ নং-১২৩৫) ১৫াট, এটিএম জেবি (প্যাকেজ নং-১২১৯) ৫টি, সেতু এন্টারপ্রাইজ (প্যাকেজ নং১২১৮-) ১৫টি,মো. সাদেকুর রহমান (প্যাকেজ নং-২০২২) ৭টি কাজ পায় ।
খোজঁ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লকের কাজ শুরু না করেও নির্মাণ কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে উপজেলা জনস্বাস্থ্য কার্যালয়ের অগ্রগতি প্রতিবেদনে। এছাড়া ২০ থেকে ৩০ শতাংশ সম্পন্ন ওয়াশব্লকের অগ্রগতি দেখানো হয় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ।
এদিকে, হাওর উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্মাণাধীন ইম্প্রুভমেন্ট টয়লেটগুলো নির্মাণকাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা এব্যাপারে উপজেলা জনস্বাস্থ্য অফিসে ধর্না দিয়েও কোন সুফল পাচ্ছেন না। গতবছর এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জেলা অফিস। তুলে নেয়া হয়েছে বরাদ্দের সকল টাকা। তবে যথাযথ তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন অফিসের কর্তা ব্যক্তিরা।
সোনালী সিন্ডিকেটের প্যাকেজে ১৫টি ওয়াশব্লক বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্মাণাধীন। চলতি বছরের মে মাসে কাজ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত আহমদ নগর ওয়াজেদ আলী, হযরত শাহ তাজ উদ্দিন (র.), সুন্দিখলা, হাজী মোহাম্মদ মোবারক আলী ও পাঠুলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেক বিদ্যালয়ে কাজ শুরুই হয়নি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসে অনেকবার যোগাযোগ করলেও কোন সুফল পাননি অভিযোগ করে মোহাম্মদ মোবারক আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবাশিষ আচার্য বলেন, বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। একই বক্তব্য পাঠুলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যায়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রহমানের।
এছাড়া ৫টি বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ পায় এটিএম জেবি। এই প্রকল্পের কাজগুলো শতভাগ সম্পন্ন দেখিয়ে পুরো বরোদ্দের টাকা উত্তোলনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কিন্তু সরেজমিন ঘুরে এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে শতভাগ কাজ শেষ হওয়ার সত্যতা পাওয়া যায়নি। বরং কাজের মান খারাপ বলে জানিয়েছেন একাধিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
অসংখ্য অনিয়মের অভিযোগ এনে রংবরন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেফায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ের ওয়াশব্লকের কাজে অসংখ্য অনিয়ম হয়েছে। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী এবং শিক্ষা অফিসে লিখিতভাবে জানিয়েছিলাম। অভিযোগে ২৯টি ত্রুটি উল্লেখ করে দিয়েছিলাম। তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাদিউল ইসলাম সরেজমিন পরিদর্শন করে মন্তব্য বইতে এ নিয়ে মন্তব্য লিখে গেছেন এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে তিনি নিজে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। এরপরও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
সাদেকুর রহমান ঠিকাদারের প্যাকেজে আরও ৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওয়াশব্লকের কাজ রয়েছে। শতভাগ কাজ সম্পন্ন না করেই সুকৌশলে কাজগুলো হস্তান্তর করা হয়ছে এবং তুলে নেওয়া হয়েছে বরাদ্দের সম্পূর্ণ টাকা। কাজ বুঝে পাওয়ার নথিতে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা স্বাক্ষর দিতে না চাইলে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী দ্রুত কাজ সম্পন্ন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁদের অনুরোধপূর্বক স্বাক্ষরে ‘বাধ্য’ করেন।
এ বিষয়ে সত্যতা স্বীকার করে নিজ করনসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রাণেশ রঞ্জন বলেন, কাজ শেষ না করে হস্তান্তরের কাগজপত্রে স্বাক্ষর নিতে আসলে তিনি সম্মত হননি। এক পর্যায়ে কমিটির সহ-সভাপতিকে দিয়ে অনুরোধ করান উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী। শেষ পর্যন্ত কমিটির অনুরোধে স্বাক্ষর করলেও অসমাপ্ত কাজগুলো এখনো হয়নি।
সেতু এন্টারপ্রাইজের প্যাকেজে ১৫টি ওয়াশব্লক নির্মাণের কাজ প্রকল্পের অনেক কাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে। নিম্নমানের কাজ ও নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করায় কাজ শেষ হওয়ার আগেই নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে। মুক্তারপুর ও কাগজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত গভীর নলকুপ দিয়ে পানি না উঠাসহ কাজ অসাপ্ত রয়েছে মর্মে জানিয়েছেন দুই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
কিন্তু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পেলেও প্রকল্পের নির্দিষ্ট কোন তথ্যও দিতে পারছেন না তারা। তাদের আচরণগত দিক থেকে প্রতিয়মান হয়েছে তাদের বদলে কাজগুলো অন্য কেউ করাচ্ছেন।
কাজের অগ্রগতি জানতে সোনালী সিন্ডিকেটের সত্ত্বাধিকারী আলমগীর হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, তাঁর কাজগুলো করছে মুরাদ নামের একজন। একই বাক্যে কথা বলেন সেতু এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী সৈয়দ তৈমুর , তাঁর কাজের সাইট দেখেন উজ্জ্বল।
আর ঠিকাদার সাদেকুর রহমান বলেন, আমার কাজগুলো অনেক আগেই শেষ করেছি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব কাজ বা সমস্যা আছে তা তালিকা করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওসমানীনগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সানাউল হক সানি। তিনি বলেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকেও অবগত করেছেন। তবে সেখানে অনিয়মের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করছেন কি না, তা জানা যায়নি।
এ বিষয়ে ওসমানীনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জয়নাল আবেদীন বলেন, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কাজ বিলম্বের ব্যাপারে মৌখিকভাবে অভিযোগ করা হয়েছিল। তিনি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে দ্রুত সে কাজ করে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন তখনই।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা সৈয়দ দিদারুল ইসলাম কায়েস তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বন্যার কারণে অনেক ঠিকাদার কাজ ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। এখন তারা আবার কাজ শুরু করবে। প্রকল্পের মেয়াদও এক বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে। কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুললে তিনি বলেন, কাজগুলোতো করে দেওয়া হবে। তাঁর মন্তব্যে কাজ না করে আগাম অগ্রগতি প্রতিবেদনে বানোয়াট তথ্য উপস্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। নিজেই কাজগুলো করাচ্ছেন, এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মুহাম্মদ শেখ সাদি রহমত উল্ল্যাহ বলেন, বিষয়টি নোট করে রেখেছেন। এ ব্যাপারে একটি লিখিত অভিযোগ প্রদানের পরামর্শও দেন তিনি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।