হবিগঞ্জে অবহেলায় শায়িত মধ্যযুগের মহাকবি সৈয়দ সুলতান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুন ২০২৫, ৬:৩৪ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের মহাকবি সৈয়দ সুলতান ওরফে সৈয়দ মিনা। সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিনের (রহ.) পঞ্চম বংশধর। ১৫শ শতাব্দীতে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যের প্রধান কণ্ঠ। এ মহাজ্ঞানী চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন নিজ ভূমি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার সুলতানশী গ্রামে। অযত্ন, অবহেলায় পড়ে আছে তার মাজারটি। রক্ষণাবেক্ষণে কারও কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ দেশজুড়ে ছড়িয়ে আছেন তার ওয়ারিশান এবং হাজারো ভক্ত। তাদের উদ্যোগে এখানে বছরে ৫ বার ওরস হয়। অবশ্য দীর্ঘদিন নানা জটিলতায় তার মাজার রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হয়নি বলে দাবি খাদেমের। এবার মাজারটি দ্রুত সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন বলেও জানান তিনি।
মাজারের খাদেম হাবিবুর রহমান শিপন বলেন, প্রতিবছর ২১ রমজান, ৬ পৌষ, ৬ ভাদ্র, ২০ পৌষ ও ২ ফাল্গুন এখানে মহাকবি সৈয়দ সুলতানের বংশধরদের উদ্যোগে ওরস পালিত হয়। এতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা অংশ নেন। মাজারগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ মূলত ভক্তদের হাদিয়া থেকে হয়। কখনোই সরকারি সহায়তা নেওয়া হয় না। এটি নেওয়া আমাদের মুর্শিদের নিষেধ। আমরা নিজেরাই ইনশাআল্লাহ দ্রুত মাজারটি রক্ষণাবেক্ষণ করব। তিনি বলেন, বেশ কয়েক বছর পূর্বে জনৈক ব্যক্তি সৈয়দ সুলতানের মাজার চট্টগ্রামে বলে দাবি করেন। এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অবশেষে গবেষক সৈয়দ হাসান ইমাম হোসাইনী চিশতী ও সিলেট অঞ্চলের গবেষকদের গবেষণায় প্রমাণিত হয় মহাকবি সৈয়দ সুলতানের মাজার হবিগঞ্জের সুলতানশীতে। আদালতও এ যুক্তির পক্ষে চূড়ান্ত রায় দেন। তাই মাজারটি সংরক্ষণে কিছু বিলম্ব হয়েছে।
স্থানীয় লেখক ও গবেষক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, মধ্যযুগের মহাকবি সৈয়দ সুলতান ছিলেন আরাকান রাজ্যের রাজসভার সভাকবি। কিন্তু তিনি থাকতেন নিজ বাড়ি হবিগঞ্জের সুলতানশীতে। তার নামেই এ এলাকার নামকরণ হয় সুলতানশী। তিনি শুধু বাংলা নয়, আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষায়ও পণ্ডিত ছিলেন। তিনি বলেন, এ মহামানবের মাজার সংরক্ষণ করা দরকার। সে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। মাজার সংস্কারের জন্য বেশ কয়েক বছর আগে তার বংশের গবেষক, পণ্ডিত ও অলি সৈয়দ হাসান ইমাম হোসাইনী চিশতী একটি ফান্ডও গঠন করে গেছেন। যদিও তা অপ্রতুল। তবুও কাজ শুরু করা যাবে। ভক্ত এবং তার বংশধরদের সহায়তায় মাজারটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
মহাকবি সৈয়দ সুলতানের ১৪তম বংশধর সৈয়দ নুরুল করিম ফুয়াদ বলেন, মাজারটি সংরক্ষণে আসলে আমাদের অগ্রজরা খুব বেশি জোর দেননি। কিছুটা নিজেদের বিভক্তির কারণেও এটি সম্ভব হয়নি। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি দ্রুত যেন মাজারটি সংক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। সরকারিভাবে যদি কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় সেটিকেও আমরা স্বাগত জানাই। মহাকবি সৈয়দ সুলতানের বংশধরদের অনেকেই বাংলা, ইংরেজি, আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। তারা একেকজন অলিও ছিলেন। বেশ কয়েকজন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন।
সরেজমিন ঘুরে ও বিভিন্ন গবেষণামূলক বই পর্যালোচনা করে জানা যায়, মধ্যযুগের মহাকবি সৈয়দ সুলতান ছিলেন সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরউদ্দিনের (রহ.) ৫ম বংশধর। তারা দুই ভাই ছিলেন। তার অপর ভাই সৈয়দ মুছা। তাদের পিতা ছিলেন সৈয়দ মেকাইল। সৈয়দ সুলতানের আদি নিবাস সদর উপজেলার লস্করপুর গ্রামে। সেখানেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পরে তিনি পৃথক হয়ে সুলতানশীতে বসতি স্থাপন করেন। তার আয়ুষ্কাল ছিল আনুমানিক ১৫৫০ খ্রি. থেকে ১৬৪৮ খ্রি. পর্যন্ত। তৎকালীন তরফ রাজ্যজুড়ে (বর্তমানে হবিগঞ্জ জেলার বৃহৎ অংশ) ছিল তাদের জমিদারি। সৈয়দ সুলতান ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি মুসলমানদের শিক্ষা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। মুসলমানরা যেন ধর্মীয় জ্ঞানের পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, আরবি, ফার্সি ভাষায়ও জ্ঞান অর্জন করেন সেজন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে-নবীবংশ, রসুল বিজয়, শব-ই-মিরাজ, ওফাত-ই-রসুল, জয়কুম রাজার লড়াই, ইবলিশনামা, জ্ঞান প্রদীপ এবং জ্ঞান চৌতিশা। আনুমানিক ১৬৪৮ খ্রি.তে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। চিরনিদ্রায় শায়িত হন নিজ বাড়ির পূর্বাংশে পুকুরের পাড়ে। এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তার বংশের পূর্বসূরিরা। তাদের কবরগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা আছে। সুন্দর মাজার হিসাবে সেগুলো সাজানো গোছানো। কিন্তু পূর্বপুরুষ মহাকবি সৈয়দ সুলতানের মাজার আছে অনেকটা অবহেলায়। দৃশ্যমান প্রধান মাজারের ঘরের বাইরে এক কোণে শুয়ে আছেন এ মহামানব। তার কবরের পাশে একটি ফলক লাগানো আছে। তারও লেখা মুছে গেছে। সুত্র-যুগান্তর