দুই উপদেষ্টার পথ ‘অবরোধ’ নিয়ে জাফলংয়ে জল্পনা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জুন ২০২৫, ৬:২৫ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্কঃ
বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানকে অনেক আগে থেকেই সিলেটে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন সুধীজনেরা। এই আমন্ত্রণের কারণ ছিল; তিনি যখন বেলা’র প্রধান নির্বাহী ছিলেন তখন তার হাত ধরেই উচ্চ আদালতের রিটে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা জাফলংসহ কয়েকটি এলাকা থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়েছিল। এতে করে প্রাণ ফিরেছিল ওইসব এলাকায়। কিন্তু ৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে অবাধে লুট চলেছে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোতে। অভিযোগ করা হচ্ছে; হাজার কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। এ কারণে দৃশ্যপট দেখতে রেজওয়ানাকে সিলেট আসার আহ্বান অনেক আগে থেকে ছিল। উপদেষ্টা হওয়ার পর শনিবার প্রথমবারের মতো জাফলং গেলেন উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান। সঙ্গে জ্বালানি ও খনিজ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানও। কিন্তু তারা এমন সময় সেখানে গেলেন তখন জাফলং কেয়ারি জুড়ে পানি আর পানি। লুটের সব চিহ্ন পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে। আর এই পানিতেই নৌকাযোগে জাফলং ঘুরে দেখলেন দুই উপদেষ্টা। জাফলংয়ে বর্তমানে রাতের আঁধারে চলছে বালু লুট। পরিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) জাফলংয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বালু লুট হচ্ছে। আর লুটের নেপথ্যে রয়েছেন জেলা বিএনপি নেতা স্ট্যালিন থারিয়াং। এবারই জাফলংয়ে কর্তৃত্ব তার হাতে এসেছে। প্রশাসনকে হাতে নিয়ে পিয়াইন নদীর উজানে খাসিয়া বস্তিতে বসেই বালু লুটের নিয়ন্ত্রণ করছেন। জাফলংয়ের বালু থেকে এখন প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হয়।
স্ট্যালিনের নিজস্ব লোক জিয়ারত খান, জাহিদ খান ও কামাল মেম্বার সরাসরি বালু লুটের নেতৃত্বে রয়েছেন। দুই উপদেষ্টা জাফলং যাবেন। এ খবর দু’দিন থেকে জাফলংয়ে চাউর হচ্ছিল। জাফলংয়ের মানুষ পাথর কোয়ারি খুলে দেয়ার পক্ষে। এখানকার একমাত্র জীবিকাই হচ্ছে পাথর ও বালু। লিজ বন্ধ থাকার কারণে মানুষ ক্ষুব্ধ। তারা লুটপাট চান না। সরকারকে রাজস্ব দিয়ে বৈধভাবে পাথর তুলতে চান। কিন্তু লিজ না দেয়ায় হরিলুট হচ্ছে। ওখান থেকে গত ১১ মাসে কোনো একটি টাকা পায়নি সরকার। উল্টো লুটের অর্ধেক টাকা প্রশাসনের পকেটস্থ হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভ আছে এলাকায়। দুই উপদেষ্টা জাফলং আসবেন- এমন খবরে তলে তলে মানুষের আবেগকে পুঁজি করে ওখানে সিনক্রিয়েট করার চিন্তা করে বর্তমান লুটেরা। যেটি ভেবেছিল গতকাল তারা সেটাই করেছে। উপদেষ্টারা রাতে অবস্থান করেন তামাবিলের নলজুড়ি রেস্টহাউসে। সকালে তারা জাফলং পরিদর্শনে হন। সঙ্গে ছিল পুলিশও। তারা বের হওয়ার আগে শতাধিক লোক নিয়ে বর্তমান বালুখেকোরা বল্লাঘাটের অদূরে সড়কে ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা চালায়। ওই সময়ের দৃশ্যপটের কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
সেখানে দেখা গেছে- বালুখেকো চক্রের সদস্যরা উপস্থিত লোকজনকে সড়কে শুয়ে পড়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। কেউ কেউ বসে পড়ার জন্য বলছেন। এ সময় ওই এলাকায় টহলে থাকা পুলিশ দল ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা উপস্থিত লোকজনকে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার অনুরোধ জানালেও কোনো কাজ হয়নি। যখন দুই উপদেষ্টার গাড়ি খুব কাছাকাছি চলে আসে তখন তারা সড়কে ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা চালায়। সড়কে দাঁড়িয়ে গেলে একপর্যায়ে গাড়িও থেমে যায়। তবে তাৎক্ষণিক পুলিশ দল এসে তাদের সরিয়ে দিয়ে সড়ক ক্লিয়ার করে দেন। এমন দৃশ্যে বিব্রত হন দুই উপদেষ্টা। তবে এ ব্যাপারে তারা কোনো মন্তব্য করেননি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন; জাফলংয়ে দুই উপদেষ্টাকে ঘিরে আরও বেশি সিনক্রিয়েট করার পরিকল্পনা ছিল। যে পরিকল্পনা আগের রাতেই প্রশাসনের কাছে পৌঁছে যায়। এই পরিকল্পনায় ছিল গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর থেকে কয়েক হাজার মানুষ এনে জাফলংয়ে জড়ো করা হবে। দুই উপদেষ্টাকে অবরুদ্ধ করেই তারা পাথর ও বালুমহাল খুলে দেয়ার দাবি জানাবে। এজন্য জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাটের প্রতিটি এলাকায় তাদের পক্ষ থেকে দাওয়াত পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। অনেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন জাফলং আসার। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে কঠোর থাকার কারণে বর্তমান লুটপাটকারীদের ডাকে কেউ সাড়া দেননি।
শ’খানেক লোকের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই জাফলংয়ের বাসিন্দা এবং বর্তমানে বালু লাইনের লোক। এদিকে; অবরোধের মুখেও গতকাল পূর্বের সিদ্ধান্ত থেকে টলেননি উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান ও ফাওজুল কবির। উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান পরিদর্শনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি পূর্বের নেয়া উদ্যোগকে পুনর্ব্যক্ত করে জানান- জাফলংসহ যেখানে যেখানে পর্যটনের সম্ভাবনা রয়েছে সে স্থানগুলোকে পর্যটনে রূপান্তরে চিন্তাভাবনা রয়েছে। পর্যটন দিয়ে যাতে জীবিকা নির্বাহ করা যায় সেটিও বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে পাথরকোয়ারি লিজে দেয়া হবে না বলে গতকালও সাফ জানিয়ে দেন তিনি।
জাফলংয়ের স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন- গতকাল দুই উপদেষ্টার গাড়ি বহর অবরোধ করা ও তাদের ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে শ্লোগান যারা দিয়েছে তাদের অনেকেই বালু ও পাথর লুটপাটকারী। ওরা গত দু’দিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এতে জাফলংয়ের পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের সম্পৃক্ততা ছিল না। তারা জানান, পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সংগঠনগুলো ডাক দিলে হাজার হাজার মানুষ জাফলং নেমে আসে। শ’খানেক লোক হতো না। এখন অবরোধের দায় তাদের কাধেই দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এজন্য তারা বিষয়টির তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তারা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা জাহিদ খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- দুই উপদেষ্টা জাফলংয়ে আসায় আমরা দেখতে যাই। পরে সেখানে সড়ক অবরোধের চেষ্টা করা হয়। তবে এতে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না বলে জানান।
এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ওরা দুই উপদেষ্টার গাড়ি বহরকে আটকাতে পারেনি। এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় সড়কের পাশ থেকে ওরা গাড়ির সামনে চলে এসেছিল। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়ার পর উদেষ্টাদের গাড়ি গন্তব্যে চলে যায়। কোনো বিশৃঙ্খল বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন তিনি।