শতকোটি টাকার মালিক সিলেটের চিনি বুঙারী আবুল!
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:২০ অপরাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
সিলেটে হাজার কোটি টাকার চিনির চোরাকারবারে নাম একটাই। বুঙারী আবুল। পুরো নাম আবুল হোসেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষ দু’বছরে চিনি ‘বুঙার’ লাইনের মালিক হয়ে দু’হাতে টাকা কামিয়েছেন। আর এই টাকা দিয়ে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেছেন। কতো টাকার মালিক বুঙারী আবুল- এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই অনুমান করতে পারছেন না। দুই বছরে প্রতিদিন ৫০-৬০ লাখ টাকা কামিয়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকার মানুষ। এ কারণে কেউ বলছেন, শতকোটি টাকার মালিক। তবে অঢেল সম্পদের মালিক যে হয়েছে, তার প্রমাণ মিলে সিলেটের চিনি চোরাকারবারের নিরাপদ জোন হরিপুরের উতলার পাড়ে গড়ে তোলা অট্টালিকা দেখে। ৩-৪ কোটি টাকা খরচ করে ওই অট্টালিকা নির্মাণ করা হচ্ছে। টাকায় অন্ধ আবুল নিজেই নিজেকে ‘চৌধুরী’ উপাধিতেও ভূষিত করতে শুরু করেছেন। ছিপছিপে গড়নের যুবক আবুল হোসেন। বয়স ৩০ কিংবা ৩২ বছর। সিলেটের হরিপুরে ক্ষমতা ও দাপটের এক জ্বলন্ত উদাহরণ তিনি। বাড়ি হরিপুর বাজারের ব্রিজের কাছে ছিল। ফেরি করে জ্বালানি তেল বিক্রি করার ব্যবসা তাদের দীর্ঘদিনের। এ সময় জাফলং কোয়ারিতে বোমা মেশিনে ফেরি করে ডিজেল বিক্রি করতো। পারিবারিক দেনার দায়ে এক সময় হরিপুরের বাড়ি বিক্রি করে চলে যান পার্শ্ববর্তী ৭ নম্বর গ্যাস ফিল্ডের উতলার পাড়ে। প্রায় ৫ বছর আগে ঢুকে পড়ে চোরাই লাইনে। সিলেট জেলা পুলিশের ডিবির সোর্স হিসেবে সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে নিয়ে আসা পণ্যের লাইনের টাকা তুলতো। আর ওই টাকা সে ডিবি ও থানা পুলিশকে দিয়ে নিজের অংশ রেখে দিতো। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সিলেট জেলা পুলিশের ডিবি উত্তরের তৎকালীন ওসি রেফায়েত চৌধুরীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে তার। ডিবি’র ওসির নিজস্ব মানুষ হিসেবে সে চোরাই সাম্রাজ্যে দাপট দেখাতে শুরু করে। দুই থেকে আড়াই বছর আগে গরু ও মহিষ চোরাচালান থেকে চিনির চোরাচালানে ডাইভার্ট হন সীমান্তের চোরাকারবারিরা। এই সুযোগে প্রথমে ডিবির ও পরবর্তীতে পুলিশ, বিজিবি’র একক লাইনম্যান হয়ে যায় আবুল হোসেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
সিলেটের চিনির কারবারিরা জানিয়েছেন, আবুল তার চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের নামে লাইনের রিসিট দিয়ে হরিপুর থেকে গাড়ি ছাড়তো। আর এই এন্টারপ্রাইজের চালান রশিদ গোটা দেশের পুলিশের কাছে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে এলাকার মানুষের প্রতিবাদের মুখে চৌধুরী নাম পরিবর্তন বিজয় নাম পরিবর্তন করে। বর্তমানে বিজয় এন্টারপ্রাইজের নামে রশিদ দিচ্ছে। প্রতিটি গাড়ি থেকে সে লাইনে ৬০ হাজার টাকা নিতো। কোনো কোনো দিন ২৫০ থেকে ৩০০টি গাড়ি ছেড়েছে। গড়ে প্রতিদিন একশ’র ওপরে চিনিভর্তি গাড়ি হরিপুর ছেড়েছে।
এতে দেখা গেছে; ডিবি, পুলিশ ও বিজিবি’র নাম করে প্রতিদিন কোটি টাকার মতো টাকা তুলতো। আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নামমাত্র টাকা দিয়ে পুরো টাকাই লুটে নিতো। এভাবে টাকার মালিক হয়েছে আবুল। ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত আবুল একচেটিয়া লাইনের ব্যবসা করেছে। এ কারণে চিনি ব্যবসায়ীদের ধারণা; আবুল শতকোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছে। আর এই টাকা কামিয়ে সে হরিপুরের পার্শ্ববর্তী গ্যাসকূপ এলাকার উতলার পাড়ে ৩-৪ কোটি টাকা খরচ করে অট্টালিকা তৈরি করছে। বাড়ির কাছে শাহ মাদার ফিলিং স্টেশন নামে একটি বন্ধ পেট্রোল পাম্প ছিল। কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ করে ওই পাম্পের ৬০ ভাগ শেয়ার কিনেছে। ফের চালু করে পাম্পের নিচতলায় নিজের চিনি ব্যবসার অফিস খুলেছে। পাম্পের মালিক আবুল কালাম শেয়ার বিক্রির কথা কাছে স্বীকার করেছে। এ ছাড়া, বটেশ্বর এলাকার একটি হাউজিং নামে-নামে কোটি টাকা দিয়ে কয়েকটি প্লট, শাহ সুন্দর এলাকার আরেকটি হাউজিংয়ে প্লট ও হরিপুর এলাকায় জমি কিনেছেন আবুল। স্থানীয়রা এসব তথ্য দিয়ে বলেছেন, ঢাকার একটি নামকরা আবাসিক এলাকায় কয়েক কোটি টাকা দিয়ে একটি ফ্লাট কিনেছেন। ঢাকার সম্পদের কথা তিনি তার পরিচিত কয়েকজনের কাছে স্বীকারও করেছেন। পুলিশের এক কর্মকর্তা ওই সম্পদ দেখভাল করেন। বছর খানেক ২২ লাখ দিয়ে নিজের জন্য একটি করোলা ফিল্টার কার কিনেছিল আবুল। ওই কার কিছুদিন ব্যবহারের পর নতুন করে ৪৬ লাখ টাকা খরচ করে করোলা ক্রস নামে আরেকটি গাড়ি কিনেছেন।
হরিপুরের স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত এপ্রিল মাসে ডিবির সাবেক ওসি রেফায়েত চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামের একটি শোরুম থেকে এককালীন টাকা দিয়ে ওই গাড়ি কিনেছেন। পুলিশ জানিয়েছে, চিনি চোরাকারবারে লাইনম্যান হওয়ার কারণে বিভিন্ন সময় তার বিরুদ্ধে জৈন্তাপুরসহ নগরের কয়েকটি থানায় মামলা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলেও তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। দু’মাস আগে আবুলকে ধরতে র্যাবের একটি টিম হরিপুরের পাম্প এলাকায় অভিযান চালালেও তাকে পায়নি। ২০২২ সালে এক মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে সে গ্রেপ্তার হয়ে ৩ দিন কারাবরণ করেছে। চিনি চোরাচালানের ঘটনায় নাম প্রকাশের পর সিলেটের দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে তাকে নোটিশ প্রদান করেছিল। পরে পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে ওই নোটিশ তামাদি করতে চেষ্টা চালিয়েছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন। আবুল চিনির ব্যবসা করে কেবল সম্পদই গড়েননি, হরিপুরের ঐতিহ্য ভেঙে নানা বেলাল্লাপনায়ও মেতে ওঠেন। কয়েক মাস আগে একটি রিসোর্টে ঢাকা থেকে আনা নারীদের নিয়ে আমোদ-ফুর্তি করেছেন তিনি। আর তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় হয়েছে। এসব ব্যাপারে কথা হয় আবুল হোসেনের সঙ্গে। জানান- তিনি চিনি’র লাইনে সম্পৃক্ত নয়। পাম্পের শেয়ার কিনে জ্বালানি তেলের ব্যবসা করেন তিনি।
৪ কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি নির্মাণ, কয়েক হাউজিংয়ে সম্পদ ক্রয়, গাড়িক্রয়সহ নানা প্রশ্নের উত্তরে আবুল জানিয়েছেন- তিনি কেবল বাড়ি নির্মাণ করছেন। আর অন্য সম্পদ সম্পর্কে তার জানা নেই। একটি কুচক্রী মহল তার বিরুদ্ধে এসব কুৎসা রটিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায়ও তার কোনো প্লট কিংবা ফ্লাট নেই বলে দাবি করেন। আর তার নামে কোনো গাড়িও কিনেনি বলে জানান। কম মূল্যের একটি গাড়ি কিনেছিলেন, সেটি পরবর্তীতে বিক্রি করে দেন।