সিলেটে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্থ, তীব্র গরমে দিশেহারা মানুষ
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬:২১ অপরাহ্ণ
সিলেটে ইদানিং কালের সবচেয়ে ভয়াবহ তাপদাহ আর বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে। একদিকে প্রচন্ড গরম খরতাপ অন্যদিকে দিনে রাতে নজিরবিহীন লোডশেডিংয়ে মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। তীব্র গরম বিদ্যুৎহীন দিবারাত্রী মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছে।
গরমের তীব্রতায় ঘর থেকে বের হওয়া যেন দায় হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ঘরে বিদ্যুতের এই আসা এই যাওয়া প্রেক্ষিতে সীমাহীন অশান্তিতে আছেন শিশু বৃদ্ধসহ নানা বয়সের মানুষ। নিদারুন কষ্টে আছে রিকশা চালক, দিনমজুরসহ নিম্ন আয়ের মানুষজন। বিদ্যুৎ নিয়মিত না থাকায় আবাসিক- অনাবাসিক সকল যায়গায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ নির্ভর অনেক ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। রাত ১টা ২টা পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় বিদ্যুতের অপেক্ষায় রাস্তায় মানুষজনকে অস্থির অবস্থায় দেখা যায়।
সিলেটে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট লোডশেডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগরীর উদ্যোক্তারা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদনে ধস নেমেছে। এভাবে চলতে থাকলে উৎপাদন বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। সিলেটের বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সিলেটের এই লোডশেডিংয়ে স্থানীয় বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো হাত নেই।
সোমবার এক বিবৃতিতে নগরীর বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি কাজী মঈনুল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আলীমুল এহছান চৌধুরী জানান, গোটাটিকর বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় হিমাগার, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক শিল্পসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৪৫টি শিল্প কারখানা রয়েছে। প্রতিদিন সেখানে চলছে উৎপাদন কার্যক্রম। এসব কারখানায় প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক কর্মরত।
সংগঠনটির বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সরকার নির্ধারিত ভ্যাট-ট্যাক্সের অর্থ পরিশোধ করা দিন দিন অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হবে এবং বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করবে। শিল্প কারখানার মুনাফার ওপর চাপ পড়বে এবং আয়-প্রবৃদ্ধিও সরকারি আয়-রাজস্বপ্রাপ্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই অন্তর্বতীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান তাঁরা।
এদিকে ৪ সেপ্টেম্বরের এনএলডিসির সারাদেশের জোনভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা, সরবরাহ এবং লোডশেড শিটে দেখা যায়, সিলেট জোনে বিদ্যুতের চাহিদা দেওয়া হয় ২১৫.৪ মেগাওয়াট। এই চাহিদার প্রেক্ষিতে এনএলডিসি সিলেট জোনে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিয়েছে ১৭৮ মেগাওয়াট। এবং স্থানীয় ঘাটতি দেখিয়ে সিলেটে ৩৭.৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে বলা হয়।
ঢাকা জোনের বিদ্যুতের চাহিদা দেওয়া হয়েছে ১২২৩.৯ মেগাওয়াট। এই চাহিদার প্রেক্ষিতে এনএলডিসি ঢাকা জোনে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিয়েছে ১২২৪ মেগাওয়াট। চট্টগ্রাম জোনের বিদ্যুতের চাহিদা দেওয়া হয়েছে ৮৮২.০ মেগাওয়াট। এই চাহিদার প্রেক্ষিতে এনএলডিসি চট্টগ্রাম জোনে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিয়েছে ৮৮২ মেগাওয়াট। এনএলডিসি এর এই বৈষম্যমূলক লোড বরাদ্দ দেওয়া প্রায় বছর দেড়েক ধরে চলছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে তুলনামূলক অনেক কম চাহিদা থাকার পরও অদৃশ্য কারণে সিলেটে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ বরাদ্দ দিচ্ছে না এনএলডিসি। একদিকে তাদের সঠিক লোড পরিমাপ না করা এবং ত্রুটিপূর্ণভাবে যে লোডের চাহিদা নেওয়া হয় সেটাও পুরোপুরি না দেওয়ায় সিলেট জোনের বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সূত্রে জানা যায়, সিলেট বিভাগে পল্লী বিদ্যুৎ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গ্রাহক রয়েছেন প্রায় ২৬ লাখ। ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টার থেকে চাহিদার থেকে কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে পিক আওয়ারে লোডশেডিং করা হয়। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ধরা হয় ডে-পিক আওয়ার। বিকল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্তও থাকে পিক আওয়ার।
এদিকে এই পিক আওয়ারের হিসেবে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ না পেলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে কমপক্ষে ১১ ঘন্টা লোডশেডিং করতে হয় সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের। অপরদিকে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে গ্রাহকরা ক্ষিপ্ত হন স্থানীয় বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।
অনেক সময় দায়িত্বরত প্রকৌশলী, অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের উপর চড়াও হন ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা। অনেকেই আবার ফোন করে ধমক দিয়ে থাকেন বলে জানান সিলেটের বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সিলেট বিতরণ বিভাগ-২এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামস-ই আরেফিন বলেন, ‘এই লোড মেনেজন্টে করে এনএলডিসি। তারা আমাদের বলে লোড মাপা হবে। কোনো লাইন বন্ধ করবেন না। সব চালু থাকবে। কিন্তু আমাদের বক্তব্য ছিল মিটারে ইতোমধ্যে সর্বোচ্চ লোড রেকর্ড হওয়া আছে। আপনার এই ডিমান্ড থেকে লোড দেন। কিন্তু তারা এটা থেকে নেয় না। মনে করেন আপনার বাসায় সারাদিন বিদ্যুৎ থাকলে বাসার এসি, ফ্রিজ, আইপিএস, লাইট ফ্যান সব চার্জ হয়ে থাকবে। তখন তারা কোনো লোড নেবে না। কিন্তু যখন বিদ্যুৎ থাকবে না তখন এসব বিদ্যুৎ নেওয়া শুরু করবে। তাহলেতো চাহিদা বেড়ে যাবে। ওই গ্যাপটা কারো নজরে আসতেছে না। আমরা চাচ্ছি সিলেটে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে। আমরা আগেও এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। মন্ত্রণালয়ের অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি যারা ভিজিট করতে আসে তাদের মিটিং, ডিসি অফিসের মিটিংয়েও আমি এই লোড বরাদ্দের বিষয়টা নিয়ে বলেছি লছি কিন্তু কিন্তু তৎকালীন ডিসি সাহেব ধমক দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দেন। উনি । উনি বলতেন বিদ্যুৎ নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। বেশি বিদ্যুৎ পাচ্ছে সিলেট।’
এ ব্যাপারে সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদির বলেন, ‘বিদ্যুতের লোড ম্যানেজমেন্ট আমাদের হাতে নেই। দীর্ঘদিন ধরে আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়টা বুঝানোর চেষ্টা করছি। আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে অবগতও করেছি। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। অথচ এই লোডশেডিংয়ে আমাদের কোনো হাত নেই। তারপরও জনগণের ক্ষোভের শিকার আমরাই হই।’
পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের সিস্টেম অপারেশন অফিসের প্রধান প্রকৌশলী ও ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বি এম মিজানুল হাসান বলেন ‘গত দুদিন থেকে আমরা ঢাকাতেও লোডশেড দিচ্ছি। যেহেতু এখন আমাদের বিদ্যুতের ক্রাইসিস বেড়েছে সেজন্য সব জোনে লোডশেড সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য ঢাকাতেও কিছু লোডশেড দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সবার সহযোগিতা চাচ্ছি। এই ক্রাইসিস থাকবে না। আগামী ১৫ তারিখ পর এই ক্রাইসিস কমে যাবে।