বাজেট ২০২৪-২৫: শিক্ষায় খরচে ‘অনীহা’, স্বল্পোন্নত ৩৩ দেশেরও নিচে বাংলাদেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ জুন ২০২৪, ৭:৫৯ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজঃ
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পথে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ভিত গড়তে মরিয়া সরকার। যার জন্য প্রয়োজন স্মার্ট ও দক্ষ মানবসম্পদ। অথচ এলডিসিভুক্ত ৩৮ দেশের মধ্যে শিক্ষায় জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দে তলানিতে পাঁচ কোটি শিক্ষার্থীর দেশ।
তালিকায় নিচের দিক থেকে তিন নম্বরে অবস্থান করছে বাংলাদেশ, যা দেশে শিক্ষার বিস্তার ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদরা।
এবার টাকার অংকে বরাদ্দ বেশি দিয়ে সরকার বাস্তবায়ন কতটা করবে, সেটা দেখার বিষয়। যদি বাস্তবায়ন না করে, তাহলে বুঝতে হবে বেশি বরাদ্দ দিয়ে মূলা ঝুলানো হয়েছে।- সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে গত ৬ জুন অর্থমন্ত্রী শিক্ষাখাতে মোট ৯৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে শিক্ষাখাতে যে বাজেট ছিল, তার চেয়ে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে এবার। টাকার অংকে শিক্ষায় এবার প্রস্তাবিত বাজেট বেড়েছে ৬ হাজার ৫৪৭ কোটি।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, জিডিপির অনুপাতে শিক্ষায় বরাদ্দ কেমন, তা দিয়েই বাজেট মূল্যায়ন কর হয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী—জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ থাকা উচিত। একই পরামর্শ জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোরও।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়েও কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। তারও আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। অর্থাৎ, ক্রমেই জিডিপির অনুপাতে শিক্ষায় বরাদ্দ কমাচ্ছে সরকার।
শিক্ষায় বরাদ্দটা ব্যয় নয়, এটা বিনিয়োগ। আমরা সেই বিনিয়োগ সঠিকভাবে করতে পারি না। আমি উচ্চশিক্ষার চেয়ে প্রাথমিক ও কারিগরি শিক্ষায় বাজেট বাড়াতে বলবো।- শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান
সিপিডির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিশ্বের ৩৩টি স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) ২০১৬-২০২৩ সাল পর্যন্ত শিক্ষাখাতে তাদের বাজেটে জিডিপির অনুপাতে কমপক্ষে ২ শতাংশ বরাদ্দ করেছে। আফ্রিকার দেশ জিবুতি, সেনেগাল এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত স্বাধীন দ্বীপরাষ্ট্র সামোয়াও বাংলাদেশের চেয়ে শিক্ষাখাতে জিডিপির অনুপাতে বেশি খরচ করে।
সেখানে বাংলাদেশ গত ১০ বছরে কখনোই বাজেটে জিডিপির অনুপাতে শিক্ষাখাতে ২ শতাংশ খরচ করেনি। উল্টো বাজেটে যে বরাদ্দ থাকে, বছর শেষে তার চেয়েও খরচ করে কম। অনেক সময় অর্থছাড় না হওয়ায় শিক্ষার প্রকল্পগুলো থমকে থাকে। অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে বছরের পর বছর ফেলে রাখা হয়। অর্থাৎ, শিক্ষাখাতে খরচের ক্ষেত্রে অতি কৃপণতা দেখানো হয়।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষাখাত এবার বাজেটের শীর্ষ পাঁচটি খাতের মধ্যে ঢুকে গেছে। এটা খুবই ভালো। কিন্তু বিষয় হচ্ছে—এ দুটি খাতে অন্য বছরে কম বরাদ্দ থাকে। তবুও বাস্তবায়নে থাকে পিছিয়ে। এবার টাকার অংকে বরাদ্দ বেশি দিয়ে সরকার বাস্তবায়ন কতটা করবে, সেটা দেখার বিষয়। যদি বাস্তবায়ন না করে, তাহলে বুঝতে হবে বেশি বরাদ্দ দিয়ে মূলা ঝুলানো হয়েছে।’
শিক্ষার বাজেট বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীও হতাশ। তিনি বলেন, ‘বাজেট ব্যবহারে দক্ষতা, সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা প্রস্তাবিত বাজেটে দেখিনি। তবে সেটা দেওয়াটাও প্রয়োজন। এমনকি শিক্ষাখাতের বরাদ্দ কেন খরচ করা যাচ্ছে না—সে বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করি।’
আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে শিক্ষার বাজেট ব্যয় করা সম্ভব হয় না বলে মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষায় যা বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেই অর্থছাড় করাতেও বছর পার হয়ে যায়। এটা স্পষ্টই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।’
বরাদ্দ থাকলেও ‘সক্ষমতা’ নেই খরচে!
চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ ছিল ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। এ মন্ত্রণালয়ে সংশোধিত বাজেট ৩০ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, সংশোধিত বাজেটে কমেছে ৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। একইভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে ৮ হাজার ৬৬৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে ৬১৮ কোটি টাকা সংশোধিত বাজেটে কমেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে ৬৫ প্রকল্পে ১৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে অর্ধেকের বেশি অর্থ ফেরত যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও একই অবস্থা ছিল এ বিভাগে। সে বার ১৩ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও খরচ হয় মাত্র পাঁচ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। বাকি ৮ হাজার ৭২০ কোটি টাকা ফেরত যায়। সরকার এ খাতে প্রতি বছর ভালো বরাদ্দ দিলেও তা খরচ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বড় অংশের টাকা ফেরত যায় বলে জানায় পরিকল্পনা কমিশন।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষার প্রকল্প বাস্তবায়ন বেশ কম, এটা ঠিক। অর্থছাড় কম হওয়ার কারণেও প্রকল্প শেষ হতে অনেক সময় দেরি হয়। কিছু ঝামেলা আছে ওখানে (শিক্ষায়)।’
বাজেট ব্যবহারে দক্ষতা, সক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা প্রস্তাবিত বাজেটে দেখিনি। তবে সেটা দেওয়াটাও প্রয়োজন। এমনকি শিক্ষাখাতের বরাদ্দ কেন খরচ করা যাচ্ছে না—সে বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করি।-রাশেদা কে চৌধুরী
একই অভিমত পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরেরও। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষাখাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম লোকবল নেই। এ খাতের প্রকল্পগুলোতে দক্ষ জনবল বা উপযুক্ত প্রকৌশলী দরকার। আবার এ জায়গায় কেনাকাটায় অনিয়মের কারণে অর্থছাড় আটকে যাওয়ার ঘটনাও বেশি ঘটে।’
শিক্ষার বাজেট নিয়ে পুরোনো ‘হতাশা’
শিক্ষাখাতে বাজেট নিয়ে হতাশ হতে হতে রীতিমতো ‘হাঁপিয়ে’ উঠেছেন বলে জানান রাশেদা কে চৌধুরীও। তিনি বলেন, ‘এবারের বাজেটেও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ মোটেও আশানুরূপ হয়নি। বারবার হতাশ, হতাশ বলতে বলতে তো আমরাই হাঁপিয়ে উঠছি। বাজেটে শিক্ষা নিয়ে সরকারের সদিচ্ছা দেখা যায়। কিন্তু তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট বরাদ্দ থাকে না। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক।’
এলডিসি উত্তরণের সময়ও শিক্ষায় জিডিপি অনুপাতে বরাদ্দ না বাড়ানো প্রসঙ্গে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা মূলত উন্নত বিশ্বের দিকে যাচ্ছি। কিন্তু এ ব্যাপারে (বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে) আমরা অনেক উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছি। দক্ষিণ এশিয়ায়ও অনেক পিছিয়ে। এটা মোটেও আকাঙ্ক্ষিত নয়। আমরা এমনটি প্রত্যাশা করি না।’
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। দায়িত্ব পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান হিসেবেও। শিক্ষায় বরাদ্দ ‘যথেষ্ট নয়’ বলে মনে করেন অধ্যাপক আবদুল মান্নানও।
তিনি বলেন, ‘এশিয়া ও আফ্রিকার কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো এত কম বরাদ্দ শিক্ষায় নেই। অন্য দেশে বরাদ্দ বেশি দেওয়া হয়। শিক্ষার এ বরাদ্দটা যথেষ্ট নয়। কিন্তু আমাদের চেষ্টা করতে হবে যতটা সম্ভব বাড়ানো। শিক্ষায় বরাদ্দটা ব্যয় নয়, এটা বিনিয়োগ। আমরা সেই বিনিয়োগ সঠিকভাবে করতে পারি না। আমি উচ্চশিক্ষার চেয়ে প্রাথমিক ও কারিগরি শিক্ষায় বাজেট বাড়াতে বলবো।’
শিক্ষার বাজেট নিয়ে গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ। প্রস্তাবিত অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘টাকার অংকে হয়তো বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দের দাবি থাকলেও সেটি পূরণ হয়নি। আবার উন্নয়ন ব্যয়ের বেশির ভাগই খরচ করা হয় অবকাঠামোতে। পরিচালন ব্যয়ের বেশির ভাগ খরচ হয় বেতন-ভাতা বাবদ। সব মিলিয়ে এবারের শিক্ষাখাতের বাজেটে প্রত্যাশার প্রতিফলন হয়নি।’