বিশ্বনাথের শুঁটকি রপ্তানী হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে
প্রকাশিত হয়েছে : ৯:৩৭:৪৪,অপরাহ্ন ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০
সুরমা নিউজ:
সিলেটের বিশ্বনাথের শুঁটকির পরিচিতি এখন বিশ্বময়। এখানে উৎপাদিত শুঁটকি রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এখানে শুঁটকি উৎপাদনের বদৌলতে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক নারী-পুরুষের। এছাড়া শুঁটকিতে উচ্চমাত্রার আমিষ বা প্রোটিন, ভিটামিন ‘ডি’ ও কোলেস্টেরল রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ২০ লাখ সিলেটের মানুষ বসবাস করেন। এর মধ্যে ৫ লাখের বসবাস শুধু যুক্তরাজ্যে। প্রবাসীদের কাছে শুঁটকির কদরই আলাদা। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে সিঁদল শুঁটকির চাহিদা ব্যাপক। লন্ডন থেকে অনেকের স্বজন দেশে এলে তারা মূলত সঙ্গে সিঁদল শুঁটকি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
শুঁটকি কম-বেশি প্রায় সবারই প্রিয়। বিশেষ করে সিলেট এলাকার প্রবাসীদের কাছে শুঁটকি অত্যন্ত প্রিয় খাবার। ফলে দিন দিন সিলেটে বাড়ছে শুঁটকির কদর। চাহিদা তৈরি হয়েছে দেশের বাইরেও।
শুঁটকি ব্যবসা করে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাদের হাত ধরে এলাকার বেকার যুবকরাও এ কাজে জড়িত হচ্ছে। ফলে একদিকে এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, অপরদিকে বেকারত্বও কমছে।
কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর নভেম্বর মাস থেকে শুঁটকির মৌসুম শুরু হয়ে মার্চ মাসে গিয়ে শেষ হয়। শুঁটকির মৌসুম আসলেই ব্যবসায়ী-শ্রমিক সবার মধ্যেই শুরু হয় প্রাণচাঞ্চল্য। সব ধরনের মাছের শুঁটকি পাওয়া গেলেও ওই এলাকায় টেংরা ও পুঁটি মাছের শুঁটকির জন্য বেশ খ্যাতি রয়েছে। প্রায় ৪০ জন ব্যবসায়ী এখানে বিনিয়োগ করেছেন। সবমিলিয়ে দুই শতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন এই শুঁটকি আড়তে। গড়ে প্রতিদিন দুইশ থেকে তিনশ টাকা করে মজুরি পাচ্ছেন শ্রমিকরা। ওই হিসেবে দুইশ জন শ্রমিকের জন্য মাসে ব্যবসায়ীদের খরচ হচ্ছে প্রায় ১২ লাখ টাকা। পুরুষদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও এখানে কাজ করেন।
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজি ইউনিয়নের মাহতাবপুরের ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে শুঁটকি সরবরাহ করছেন। অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন এই চার মাস শুঁটকি তৈরির ভরা মৌসুম। এই সময়ে বাজারে মাছের মূল্য কম থাকায় বেশি পরিমাণে শুঁটকি তৈরি সম্ভব হয়। বিশ্বনাথ উপজেলায় বানানো এই শুঁটকি শুধু দেশের বাজারেই নয়, চলে যায় ব্রিটেন, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে। ফলে মাহতাবপুরের শুঁটকির বাজার একটি শিল্প হয়ে উঠেছে। এ ব্যবসা নিয়ে অনেক সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের বিশ্বনাথ ও জালালাবাদ এলাকার মধ্যবর্তী মাহতাবপুরের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে শুঁটকির প্রায় ৪০টি ডাঙ্গি রয়েছে। এখানে খাঁচার ওপর মাছ শুকিয়ে এখন শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে। আর শুঁটকি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ২ থেকে ৩শ নারী-পুরুষ। মাহতাবপুরের প্রায় তিন শতাধিক নারী ও পুরুষ শ্রমিক শুঁটকির জন্য মাছ কাটা এবং ধোয়ার কাজ করেন। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজের বিনময়ে তারা মজুরি পান ১৩০-১৫০ টাকা। এসব কাটা মাছে লবন ছিটিয়ে ৩/৪ ঘন্টা রেখে রোদে শুকানোর জন্য প্রথমে চাঁচ বিছিয়ে মাটিতে এবং কিছু শুকানোর পর মাঁচায় দেওয়া হয়। প্রায় ৫ থেকে ৬ দিন শুকানোর পর টিল মেরে প্রক্রিয়াজাত করে শুঁটকি তৈরি করা হয়।
জানা গেছে, এখানে পুঁটি, টেংরা, বাইম, চিংড়ি, চাঁন্দা ও কাইখ্যা মাছের শুঁটকি করা হয়। এসব শুঁটকি ব্রাম্মণবাড়িয়া ও ঢাকার কিছু ব্যবসায়ী পাইকারি দরে ক্রয় করে নেন। এরা আবার এগুলো ভারতে বিক্রি করেন। তাদের বিক্রিত শুঁটকিগুলো সব জায়গায় বেশ জনপ্রিয়। তাই তারা এ মৌসুমে দুই থেকে তিন কোটি টাকার শুঁটকি পাইকারি দরে বিক্রি করে থাকেন বলে জানান উৎপাদনকারীরা।
মাহতাবপুরের একটি বড় শুঁটকির আড়তের মালিক আব্দুল মান্নান জানান, তারা বছরের ৬ মাস শুঁটকি বিক্রি করতে পারেন। তাদের তৈরি শুঁটকিগুলো পাইকারদের কাছে খুবই জনপ্রিয়।
শুটকির আড়তের নারী শ্রমিক জুলেখা বেগম বলেন, ‘সারাদিন কাজ করে মাত্র ১৫০ টাকা মজুরিতে আমাদের সংসার চলে না। আমরা গরিব মানুষ। নদীতে আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। অভাবের সংসার হওয়ায় আর বাচ্চাদের লেখাপড়া করানোর জন্য কোনো কাজ না পেয়ে অল্প টাকায় এ কাজ করি। কিন্তু এতে আমাদের সংসার চলে না।’
এ ব্যবসার ভবিষ্যৎ আছে দাবি করে শুঁটকি উৎপাদনকারী মাহতাবপুর গ্রামের জসিম উদ্দিন, ধলিপাড়া গ্রামের আলতাব মিয়া ও দিঘলী রামপুরের কালা মিয়া জানান, শীত মৌসুমে তারা শুঁটকি উৎপাদন করে থাকেন। এটা অল্পদিনের লাভজনক ব্যবসা। সিলেটের সবচেয়ে বড় পাইকারি আড়ত ছড়ারপাড়ে (মাছিমপুর) এসব শুঁটকি বিক্রি করা হয়। সেখান থেকে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে সারাদেশে ও বিদেশে পৌঁছে যায়।
উপজেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, বিশ্বনাথের মাহতাবপুরে গত ২০১৮/১৯ বছরে ২৯৭ মেট্রিকটন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি তৈরি হয়। এগুলো দেশের বিভিন্ন শহরে সরবরাহ করা হয়।
বিশ্বনাথ উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. সফিকুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, ‘আমাদের কাছে শুঁটকি ব্যবসায়ীদের কোনো তালিকা নেই। তবে উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর থেকে সবসময় তদারকি রয়েছে।’