কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ’র শৈশব কেটেছে সিলেটে
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুলাই ২০১৭, ৬:১৫ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
তাঁর শৈশব কেটেছে সিলেটে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুও এখানে। বড় হয়েও বারবারই সিলেটে ফিরে এসেছেন হুমায়ুন আহমেদ। কখনো মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সৈনিক হিসেবে, কখনো হাওরে জ্যোৎস্না উপভোগের রোমান্টিকতায়, আবার কখনোবা শাহজালালের মাজার জিয়ারতের আধ্যাত্মিক আরাধনায়। নানারুপে, নানা কারনে-অকারনে তিনি এসেছেন শৈশবের স্মৃতিময় শহর সিলেটে।
নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থসহ বিভিন্ন লেখায় হুমায়ুন লিখেছিলেন, সিলেট তার প্রিয় শহর। এ শহরের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়।
শুধু সিলেটসহ ইহজাগতিক সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে হুমায়ূন চার বছর আগে পাড়ি জমিয়েছেন পরলোকে। ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকীতেও চোখের জলে অনে ভক্তই স্মরণ করেছেন হুমায়ূন আহমেদকে।
হুমায়ূন আহমেদ সর্বশেষ ২০১১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সিলেট এসে মাজার জিয়ারত করে যান। কে জানতো এই তাঁর শেষ যাওয়া। আর কখনোই প্রিয় শহরে ফিরবেন না হুমায়ুন।
হুমায়ুন আহমদের জন্ম হাওরপাড়ের জেলা নেত্রকোনায়। জন্মের পরপরই বাবার চাকরীর সুবাদে স্ব-পরিবারে সিলেট চলে আসেন তারা। বাবা ফয়জুর রহমান ছিলেন সিলেট কোতোয়ালী থানার উপপরিদর্শক। এরপর বিশ্বনাথ থানার ওসির দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন ফয়জুর রহমান। বাবার চাকরীর সুবাদে সিলেটে শৈশবকাল কাটে হুমায়ুন আহমেদের। নগরীর মীরাবাজারের একটি বাসায় থাকতেন তারা। একচালা আধাপাকা হুমায়ুনদের সেই বাসাটি এখন পরিণত হয়েছে অট্টালিকায়। তবে হুমায়ুন আহমদেদের ব্যবহৃত পানির ইন্দিরাটি (কুয়া) এখনো আছে।
১৯৮০ সালে সিলেট সফরে এসে ওই বাসা দেখে যান হুমায়ুন। মীরাবাজারস্থ কিশোরী মোহন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় হুমায়ুন আহমেদের। এই বিদ্যালয়েই প্রথম পাঠ নেন হুমায়ুন অনুজ জাফর ইকবাল ও বোন সেপু।
এই বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে হুমায়ুনের বন্ধু হয়ে ওঠেন শংকর। দারিদ্রতার কারনে প্রাথমিকেই থেমে যায় শংকেরর প্রাতিষ্টানিক শিক্ষার দৌঁড়। জীবিকার তাগিদে পত্রিকার হকারের চাকরি নেন শংকর। এই সময়ে হুমায়ুন আহমেদ হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্রে। তবু ভুলে যাননি শৈশবের বন্ধুকে। সিলেট আসলেই দেখা করতেন শংকরের সাথে। শৈশব নিয়ে তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থের বড় অংশই জুড়ে আছে শংকরের নাম। কয়েক বছর পূর্বে এই শংকর মারা যান।
আওয়ামী লীগের গত শাসনামলে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলের নামকরণ ক’জন বিশিষ্ট ব্যাক্তির নামে করার সিদ্ধান্তের বিরোধীতায় আন্দোলনে নামে মৌলবাদী গোষ্ঠি। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করেন হুমায়ন অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন হক। সে সময় মৌলবাদী গোষ্টির বিরুদ্ধে সিলেটে এসে অনশন করেন হুমায়ুন আহমেদ।
মৌলিবাদী চক্রের রক্তচক্ষু, হত্যার হুমকী, সমরসাজ, পথেপথে বাঁধা- কিছুই সেদিন তাকে দমাতে পারেনি। মৌলবাদের বিরুদ্ধে এই আপোষহীন মনোভাব, মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে এক লেখকের রাজপথে আন্দোলনে নেমে আসা সেই দিনটির পর থেকেই হুমায়ুন আহমেদ সিলেটবাসীর হৃদয়ে এক অনন্য আসন গড়ে নেন। তাই হুমায়ুন আহমেদ সিলেটবাসীর কাছে একজন লেখকমাত্রই নন- সহসংগ্রামী, মৌলবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন নামও।
হুমায়ুন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমানরা ছিলেন ৫ ভাই ১ বোন। সিলেটে অবস্থানকালে ছোট ভাই আজিজুর রহমান আহমেদকে এমসি কলেজে পড়ানোর জন্য সিলেট নিয়ে আসেন ফয়জুর রহমান। পরবর্তীতে বদলি হয়ে ফয়জুর রহমান সিলেট ছাড়লেও থেকে যান আজিজুর রহমান। বুক সেন্টার লাইব্রেরি নামে একটি বইয়ের দোকান খুলে সিলেটেই স্থায়ী হয়ে যান তিনি। সিলেট নগরীর হাওয়াপাড়ায় বাস করেন হুমায়ুন আহমেদের চাচার পরিবার। তাই সিলেটের সাথে পারিবারিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে হুমায়ুনের।
সিলেটে বসবাসরত হুমায়ুন আহমদের চাচাতো ভাই (আজিজুর রহমান আহমেদের ছেলে) মঞ্জুর আহসান জানান, ‘জন্মের পর হুমায়ুন আহমদের মা অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার বাবা আজিজুর রহমান তাকে (হুমায়ুন আহমেদ) দেখাশোনা করতেন। ৪-৫ মাস তিনিই তাকে লালন-পালন করেন। এ জন্য আমাদের পরিবারের সাথে তার বিশেষ সখ্যতা ছিলো।’
তিনি জানান, ‘সর্বশেষ ২০১১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাজার জিয়ারতে আসেন বাচ্চু ভাই (হুমায়ুন আহমেদের পারিবারিক নাম)। সেসময় নগরীর রোজভিউ হোটেলে ওঠেন তিনি। মাজার জিয়ারতের পর আমাদের পরিবারের সাথে দেখা করে ঢাকায় ফিরে যান। এর পরপরই তিনি চাচীকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে যান মেডিকেল চেকআপ করাতে। সেখানে তার অসুখ ধরা পড়ে।’
মঞ্জুর আহসান জানান, ২০০৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর কিশোরী মোহন বিদ্যালয়ের ৭৫ বছরপুর্তি অনুষ্ঠানে প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আসতে চেয়েছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি তিনি।
মঞ্জুর বলেন, বাচ্চু ভাই প্রায় বলতেন- ‘সিলেটের সাথে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়। এখানে পড়ে আছে আমার শৈশব। পবিত্র এ মাটিতে আমার চাচা-চাচী শায়িত, তাই সিলেটে বার বার ফিরে আসতে মন চায়।’
তিনি আরো জানান, ‘হুমায়ুন আহমেদ বাউল হাসন রাজার খুব ভক্ত ছিলেন। ভক্ত ছিলেন হাওরের। এই দুয়ের টানে প্রায়ই ছুটে আসতেন সুনামগঞ্জে। রাতের বেলা হাওরে বজরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন জ্যোৎস্না দেখতে।’