লন্ডন হসপিটালে ভুল চিকিৎসায় বাংলাদেশি শিশুর মৃত্যু : ৩ বছর পর ভুল স্বীকার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ জানুয়ারি ২০১৭, ২:১৩ অপরাহ্ণ
লন্ডন অফিসঃ তিন বছর পর ভুল চিকিৎসা ও দায়িত্বে অবহেলার কথা স্বীকার করলো রয়্যাল লন্ডন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটির ভুল চিকিৎসার কারণে ২০১৩ সালে ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তোফিকুল করিম সুহৃদ ও নারগিস ফারজানা ন্যান্সি দম্পত্তির ২০ মাস বয়সী সন্তানের মৃত্যু হয়। ভুল চিকিতসার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করা ওই শিশুর নাম তাহমিদ সুহৃদ।
দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বার্টস হেলথ এনএইচএস ট্রাষ্ট দায়িত্বে অবহেলা ও ভুল চিকিতসার কথা স্বীকার করে নিয়েছে। আউট অব কোর্ট সেটেলম্যান্টে নিজেদের দায় স্বীকার করে তাঁরা পরিবারটিকে ক্ষতিপূরণ দিতেও সম্মত হয়েছে। ক্ষতিপূরণের পরিমান ৩৫ হাজার পাউন্ড বলে জানা গেছে। গত ১৮ জানুয়ারি বুধবার ডেইলি মেইলে প্রকাশিত সংবাদ থেকে এসব কথা জানা যায়।
শিশুটির বাবা তোফিকুল করিম সুহৃদ ডেইলি মেইলকে বলেন, চিকিতসকরা শিশুটির অন্ত্রে (বাউয়েল) সমস্যা চিহ্নত করতে ব্যর্থ হয়েছে। পরিবারটির আইনজীবীর সাথে কাজ করা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ তাহমিদের পুরো চিকিতসা প্রক্রিয়ায় হাসপাতাল কর্মীদের অব্যাহতভাবে ভুল করার প্রমাণ পেয়েছেন। তাঁরা প্রমাণ করেন যে, হাসপাতাল কর্মীরা তাহমিদের মুখে যে খাদ্য নল লাগিয়েছিলেন, তা ভুলভাবে লাগানো হয়েছিলো। যে কারণে দীর্ঘ ১০ মাস ওই নল লাগানো থাকা অবস্থায় তাহমিদ নানা রোগ এবং ব্যথা বেদনায় ভুগতে থাকে। এ সময়ে বমি এবং ডায়রিয়ার পাশাপাশি যন্ত্রনায় ছটপট করতো। খাদ্য নল সঠিকভাবে না লাগানোর কারণে তা তাহমিদের নাড়িভূড়িতে (অন্ত্রে) জটিলতা এবং সংক্রমণের সৃষ্টি করে। যে কারণে তার স্বাস্থের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে।
বার্টস এনএইচএস ট্রাষ্ট্র শুরুতে নিজেদের ভুল এবং দায়িত্বে অবহেলার কথা অস্বীকার করে।
২০১২ সালে ১২ মার্চ লন্ডনের কুইন্স হাসপাতালে তাহমিদের জন্ম। সে শর্ট ট্রমা ভাওয়েল বা ছোট পাকস্থলী নিয়ে জন্ম নেয়। সাধারণত জন্মের সময় একটি শিশুর পাকিস্থলীর আয়তন থাকে ১০০ সেন্টিমিন্টার। কিন্তু তাহমিদের পাকস্থলী ছিল ২৭ সেন্টিমিটার। জন্মের পরপরই শিশুটির পাকস্থলীতে অপারেশনের প্রয়োজন হলে তাকে রয়্যাল লন্ডন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ২০ মাস পর্যন্ত রয়্যাল লন্ডন হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোনমি বিভাগে চিকিৎসাধীন ছিল তাহমিদ। তার পাকস্থলী স্বাভাবিক করতে ৯টি অপারেশন করা হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর শেষ অপারেশনটি করা হয়। অপারেশনের পর শিশুটির ক্ষতস্থানে থ্রি এম পলিফিল্ম টেপ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। অপারেশন ঠিক মতো না হওয়ায় ক্ষতস্থান দিয়ে ফ্লুইড (তরলজাতীয় পদার্থ) গড়িয়ে পাকস্থলীর ভেতরে ইনফেকশন হয়। শিশুটির বাবা-মা তাৎক্ষণিকভাবে ডাক্তারের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও ডাক্তারের সাক্ষাৎ পাননি। শিশুটির অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। পরদিন ১০ ডিসেম্বর শিশুটি মারা যায়।
তাহমিদের মৃত্যুর পর চিকিতসকরা সুহৃদ-ন্যান্সিকে এই বলে সান্ত¡না দেন যে, জন্মের সময় দুর্বল থাকায় সে মারা গেছে। তবে এমন যুক্তি মানতে না পেরে তদন্তের দাবি করে শিুশুটির পরিবার।
ক্লিনিক্যাল কোয়ালিটি কন্ট্রোল বিভাগে অভিযোগ করলে কোনও প্রতিকার পাননি এই দম্পতি। বারবার অভিযোগের ফলাফল জানতে চাইলেও তারা এ বিষয়ে কথা বলে ২০১৪ সালের এপ্রিলে। ৮ মাস পর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে রয়্যাল লন্ডন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার অবহেলার কথা স্বীকার করলেও ভুল চিকিৎসার বিষয়টি এড়িয়ে যায়। এরপর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেন সুহৃদ দম্পতি। ২০১৫ সালে দ্বিতীয় দফা তদন্তের পর এনএইচএস চিকিৎসায় কোনও ধরনের অবহেলা ছিল না বলে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।
এরপর বিষয়টি নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে মেডিকেল নেগলিজেন্স বিষয়ক আইনী প্রতিষ্ঠান ইরউইন মিচেল- কে নিয়োগ দেয়। প্রতিষ্ঠানটি পুরো বিষয়টি অনুসন্ধান করে চিকিতসার ধারাবাহিক ভুলগুলো একটি তালিকা তৈরি করে এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলার বিষয়গুলো চি?িত করে। এরপর এক সপ্তাহের মধ্যেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের ভুলের কথা স্বীকার করে আউট অব কোর্ট সেটেলম্যান্টে রাজি হয়। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সুহৃদের আইনজীবী বিষয়টি গণমাধ্যমে জানান।
সুহৃদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার সন্তানের চিকিৎসার সময়ে দেখেছি অনেক বাঙালি পরিবারের শিশু এনএইচএসের গাফিলতি আর ভুল চিকিৎসার কারণে মারা যাচ্ছে। কিন্তু কোনও বাবা-মাকে সাহস করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখিনি আমি। এ কারণেই আমি এনএইচএসের ভুল চিকিৎসার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তাদের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য করি।’
সুহৃদ-ন্যান্সি দম্পতি মনে করেন, হারানো সন্তান আর কোনোদিন ফিরবে না। কোনো প্রতিদান তাদের হারানো সন্তানের অভাব পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে তারা সত্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন সেটাই সান্তনা। তাঁরা মনে করেন এই আইনি লড়াইয়ে আজ যে সত্য উম্মোচিত হয়েছে তাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশিরা ভুল চিকিৎসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস পাবে।