ব্রিটেনে বাংলাদেশি পাত্রপাত্রী সংকট : সন্তানদের বয়স বাড়ায় উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ নভেম্বর ২০১৬, ৭:৩০ অপরাহ্ণ
লন্ডন অফিস:
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ছেলে-মেয়েদেরকে বিয়ে দেয়া তাদের পরিবারের জন্য কমবেশি উদ্বেগের। যেসব পরিবার এদেশে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন তাদের অভিভাবকরা বলছেন, পছন্দসই বাংলাদেশি পাত্রপাত্রী না পাওয়ায় সন্তানদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। আর দেশে নিয়ে বিয়ে দেওয়ার ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে চাননা । ব্রিটেনে বসবাসরত অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা এখন আর চায় না দেশে গিয়ে বিয়ে করতে। এছাড়া ইমিগ্রেশন আইনে ব্যাপক পরিবর্তন এর বড় কারণ।|
অন্যদিকে ছেলে-মেয়েরাও বাংলাদেশি নয়, এরকম কোনো ‘বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড’ থাকা সত্ত্বেও পরিবারের কাছে তা প্রকাশ করতে দ্বিধা করছে। বাঙ্গালী অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুরমানিউজ টোয়েন্টিফোর.ডটকমকে বলেন,”বাবারে বড়ো মছিবতর মাঝে আছি, না ইদেশো কইন্যা মিলের না দেশো যাইতাম পাররাম। পুয়া আমার বুড়া অইজাইবো আর নায় কোনদিন ইংলিশ বেটি বিয়া করিয়া আনবো। দেশো নিয়া বিয়া করাইলে ইবেটিরে ইখানো(লন্ডন) আনা বড় মুশকিল। কতো নয়া আইন করছে ইতা হুনিয়া পুয়ায় কয় দেশো যাইতো নায়। আর আমারো ইচ্ছা নায় দেশো বিয়া করাইতাম। বিয়া করাইয়া কার পুরির জীবন কষ্টর মাঝে ফালাইতাম” ।
এরকম বেশ কয়েকজন অভিভাবক খোলামেলাভাবেই বলেছেন তাদের দুশ্চিন্তার কথা। লোকলজ্জার ভয়ে তারা নাম বলতে চাননি। এরকম একজন মা, ৪০ বছর ধরে আছেন ব্রিটেনে, তার দুই মেয়ের জন্যে বহু বছর ধরে পাত্র খুঁজছেন। তাদের বয়স ৩৪ আর ৩২। জানালেন, দুশ্চিন্তায় প্রায়শই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।‘ভালো পাত্র পাওয়া খুব কঠিন। ১০ বছর ধরে খুঁজছি। কিন্তু কোথাও মেলাতে পারছি না’ বললেন তিনি। তিনি বলেন, যারা নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেন তাদের অসুবিধা নাই কিন্তু যাদের জন্যে ছেলে-মেয়ে খুঁজতে হয় তাদের বিয়ে দেয়া খুব কঠিন।
বাবা-মায়েরা আগে ছেলে-মেয়েদেরকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিতেন। তারমধ্যে কিছু আছে জোরপূর্বক বিয়ে। কিন্তু সেসব বিয়ের অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো না হওয়ায় পিতা-মাতারাও এখন আর সেধরনের বিয়েতে আগ্রহী নন।
ব্রিটেনে একটি কলেজের শিক্ষক রেহানা বেগম এসব পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়ে লেখালেখি করেন। তিনি সুরমানিউজ টোয়েন্টিফোর.ডটকমকে বললেন, দেশে অনেক আত্মীয় স্বজন থাকায় বিয়েটা কোনো সমস্যা নয়, কিন্তু এখানে অপশন খুব কম। বহু ছেলে-মেয়ে আছে যাদের বয়স হয়ে যাচ্ছে কিন্তু বিয়ে হচ্ছে না। তাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশি মেয়েরা পড়ালেখা ও চাকরি-বাকরিতে ছেলেদের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। ফলে মেলানো যায় না।’
ষাটের দশকে এদেশে এসেছেন এরকম একজন, নাম বলতে চাননি, একটি লোকাল কাউন্সিলে বহু বছর ধরে কাজ করছেন। নিজের ছেলে-মেয়েদের সবাইকে বিয়েও দিয়েছেন। ভারতীয় এক মেয়ের সাথে এমাসেই বিয়ে হয়েছে ছোট ছেলের, তারা এখন হানিমুনে। তিনি বললেন, বাংলাদেশি অভিভাবকরাও নিজের দেশের বাইরে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিতে চান না। এটাও একটা সমস্যা। ‘বিয়ের ব্যাপারে আমরা থানার বাইরে যেতে চাই না, তারপরে জেলার বাইরেও যেতে চাই না। যেতে চাই না দেশের বাইরেও, ফলে বাজারটা অত্যন্ত ছোট আর সীমিত হয়ে গেছে’ যোগ করেন এই গবেষক।
বিয়ের এই সমস্যাকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে গড়ে উঠেছে বহু প্রতিষ্ঠান যারা ঘটকালি করেন। পূর্ব লন্ডন মসজিদে এরকম একটি সংস্থা আল ইহসান ম্যারেজ ব্যুরো। সেখানে যাওয়ার পর আধ ঘণ্টার মধ্যেই বেশ কয়েকজন ফোন করে পাত্রপাত্রীদের ব্যাপারে খোঁজ নিলেন।
আল ইহসানে রেজিস্ট্রেশন করা আছে ৭০০এর মতো পাত্রপাত্রী, যাদের দুই-তৃতীয়াংশই নারী। তাদের তালিকায় দেখা যাচ্ছে- আপনি কি নন-ব্রিটিশ কাউকে বিবেচনা করবেন- এই প্রশ্নে ৯৮শতাংশই বলছেন, না। কিন্তু বাংলাদেশি নন এরকম পাত্রপাত্রীর ব্যাপারে আপত্তি নেই অনেকেরই। বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন ঘটক আনু মিয়া। স্থানীয় লাইব্রেরির কর্তৃপক্ষ ঘটকালি করার জন্যে তাকে সেখানে সপ্তাহে দুদিন বসতে দিয়েছে। ১৪ বছর ধরে এ কাজ করছেন তিনি।
আনু মিয়া সুরমানিউজ টোয়েন্টিফোর.ডটকমকে বলেন, ‘ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে অভিভাবকদের একটা গ্যাপ আছে। বাবা-মায়েরা এসে ছবি নিয়ে যান, সন্তানদেরকে দেন কিন্তু তারা খুলেও দেখে না। কারণ তাদের ইতোমধ্যেই সুব্যবস্থা করা আছে।’ ‘সুব্যবস্থা’ বলতে তিনি বলছেন, ইতোমধ্যেই তারা তাদের ইংরেজ পার্টনার বাছাই করে রেখেছেন যা তারা বাবা-মায়ের কাছে গোপন রাখছেন।
তিনি জানান, বাংলাদেশি পাত্রপাত্রীর অভাবের কারণে পাকিস্তানি, আরবি ও মিশরের মুসলমানদের সাথেও বাংলাদেশিদের বিয়ে হচ্ছে। প্রচুর বিয়ে হচ্ছে ইংরেজদের সঙ্গেও। দুই কন্যার বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকা মা-ও বলছেন, ইংরেজ হলেও আপত্তি নেই। এমনকি অমুসলিম হলেও। তবে তিনি চাইবেন তাকে যেনো ধর্মান্তরিত করা হয়। এই মায়ের পরামর্শ হচ্ছে ছেলেমেয়েরা নিজেরাই যেনো তাদের পার্টনার খুঁজে রাখেন।
আলতাব আলী পার্কের দুই ব্রিটিশ বাংলাদেশী তরুণও স্বীকার করেছেন যে, বাবা-মার যতো আপত্তিই থাকুক না কেনো তারা তাদের পছন্দেই বিয়ে করবেন। অভিভাবকরা বলছেন, বিয়ের জন্যে শুধুমাত্র বাংলাদেশীদের মধ্যে সীমিত থাকলে ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি আরো প্রকট হয়ে উঠবে।
আর একারণেই বাংলাদেশি পরিবারগুলো, অন্তত বিয়ের ব্যাপারে যে আরো বেশি আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে বাধ্য হবে সেটা নিয়ে তাদের কোনো সন্দেহ নেই।