পাউন্ডের দরপতনে বিপদে বাংলাদেশ : রেমিটেন্স কমেছে ৩০ মিলিয়ন ডলার
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ অক্টোবর ২০১৬, ৩:২৭ পূর্বাহ্ণ
লন্ডন অফিসঃ বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে পাউন্ডের দরপতন। পাউন্ডের দাম কমে প্রতি পাউন্ডে মিলছে মাত্র ৯৮ টাকা (প্রায়)। ফলে প্রতি মাসে যেখানে যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা ৭০ থেকে ৮০ মিলিয়ন ডলার দেশে প্রেরণ করতেন সেখানে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রেমিটেন্স প্রেরণের পরিমাণ কমে হয়েছে মাসে ৪৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলার। আবার পাউন্ডের দরপতনে ব্রিটেন থেকে ক্রয় আদেশ কমে যাওয়া এবং বিনিময় হারের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়। লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এশিয়ার বাজারে গত শুক্রবার হঠাৎ করেই পাউন্ডের ‘ফ্ল্যাশ ক্র্যাশ’ বা বড় ধরনের দরপতন হয়। লেনদেনের একপর্যায়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দাম ৬ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। এতে প্রতি পাউন্ডের দর কমে ১ দশমিক ১৮ ডলারে নেমে আসে, যা গত ৩১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। দিন শেষে এশিয়ার বাজারে পাউন্ডের দর কমার হার দাঁড়ায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ। পরে লন্ডনের বাজারে ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দর কমে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। সেখানে প্রতি পাউন্ড কেনাবেচা হয় ১ দশমিক ২৪ ডলারে।
গত জুন মাসে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত গণভোটে দেশটির মানুষ ইইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছাড়ার পক্ষে রায় দেয়ার পর থেকেই পাউন্ডের পতন শুরু। তখন পাউন্ডের লেনদেন বন্ধ করে পরিস্থিতি সামাল দেয় ব্রিটিশ সরকার। এরপর গণভোটের ওই রায় কার্যকর নাও হতে পারে এমন খবরে বাজার কিছুদিন শান্ত ছিল। কিন্তু গত রোববার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে গণভোটের রায় কার্যকর করার ঘোষণা দেন। ফলে পরদিন সোমবার থেকে আবারও পাউন্ডের দরপতন শুরু হয়। তবে শুক্রবারের ওই আকস্মিক পতন বাজারের স্বাভাবিক আচরণ না-কি কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঘটেছে তা অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড।
জুন মাসে অনুষ্ঠিত গণভোটের আগে প্রতি পাউন্ডের বিনিময়ে ১২০ টাকা পাওয়া যেত। গণভোটে বেক্সিটের পক্ষে রায় যাওয়ার পর তা কমতে কমতে ১০৩ টাকায় নেমে আসে। আর শুক্রবারের দরপতনের পর প্রতি পাউন্ডে দেশে প্রেরণ করা যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৯৮ টাকা। মূলধারার অনলাইনভিত্তিক অর্থপ্রেরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দিচ্ছে আরও কম। গতকাল ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন প্রতি পাউন্ডের বিনিময়ে দিচ্ছিলো মাত্র ৯৬ টাকা।
বাংলাদেশ হাইকমিশনের বাণিজ্যবিষয়ক কন্সুলার শরিফা খান বলেন, পাউন্ডের দরপতনের ফলে নানাভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। প্রথমত, পাউন্ডের বিনিময়ে কম টাকা পাওয়া যাচ্ছে বলে যুক্তরাজ্য থেকে প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণ বেশ কমে গেছে। আবার যে পরিমাণ পাউন্ড প্রেরণ করা হচ্ছে বিনিময় হারের কারণে তাতেও মিলছে কম টাকা। তিনি জানান ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে রেমিটেন্স গেছে মোট ৮৬৩ দশমিক ২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর চলতি অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে অর্থ্যাৎ সেপ্টেম্বর সময়ে রেমিটেন্স গেছে মাত্র ১৬৮ দশমিক ৮৮ মিলয়ন ডলার। পাউন্ডের অব্যাহত দরপতনের কারণে সেপ্টেম্বরের পর রেমিটেন্স প্রবাহ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শরিফা খান বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তৃতীয় বৃহত্তম একক গন্তব্য যুক্তরাজ্য। কিন্তু পাউন্ডের দরপতন বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ব্যয়বহুল করে তুলেছে। এতে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাজ্য থেকে ক্রয় আদেশ কমে যাওয়ার খবর পাচ্ছেন বলে জানা তিনি। তিনি জানান, গত অর্থ বছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে ৪ হাজার ১৭ দশমিক ৬০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। চলতি বছর যুক্তরাজ্যে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ৩১৫ মিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হলেও প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৬৪৩ দশমিক ০৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। শরিফা খান বলেন, লেনদেনের বিষয়টি ডলারে হলেও পাউন্ডের বিনিময় হার প্রভাব ফেলছে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য থেকে পণ্য আমদানির জন্য এই দরপতন ভাল। কিন্তু বাংলাদেশ বছরে মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলারের পন্য যুক্তরাজ্য থেকে আমাদনী করে। ফলে পাউন্ডের দরপতন বাংলাদেশের জন্য বড় ধরণের ক্ষতিই করছে।
এদিকে বাংলাদেশি অর্থপ্রেরণকারী প্রতিষ্ঠান এমটিবি এক্সচেঞ্জের প্রধান নির্বাহী আনিসুর রহমান বলেন, একান্ত জরুরি না হলে কেউ আর দেশে অর্থ প্রেরণ করছেন না। বরং অনেকই বাংলাদেশ থেকে টাকা কীভাবে আনা যায়- তা জানার জন্য ফোন করছেন। একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থে এনে আগে যুক্তরাজ্যে একটি বাড়ি কিনতে যদি ১২০ টাকা লাগতো, এখন লাগছে ৯৮ টাকা। ফলে দেশে অর্থ প্রেরণ দূরে থাক অনেকেই চাচ্ছেন দেশ থেকে টাকা এনে যুক্তরাজ্যে বিনিয়োগ করতে। তবে সাধারণ প্রবাসীরা যাদের দেশে অর্থ প্রেরণ করতেই হয় তারা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশে পাউন্ডের দাম আরও কমেছে
সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে ৯ অক্টোবর রোববার দেশের মুদ্রাবাজারে যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ড স্টার্লিংয়ের বিনিময় হার কমার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ ব্রিটিশ পাউন্ডের বিপরীতে স্থানীয় টাকা এখন দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী দেশের অধিকাংশ ব্যাংকেই রোববার প্রতি পাউন্ড ১০০ টাকার নিচে লেনদেন হয়েছে। টাকার বিপরীতে পাউন্ডের এই বিনিময় হার গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০১০ সালের ৯ জুন প্রতি পাউন্ডের দাম ছিল ১০০ টাকা ১২ পয়সা। দেশের মুদ্রাবাজারে কয়েক দিন ধরেই পাউন্ডের বিনিময় হার পড়তির দিকে। তারই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক রোববার প্রতি পাউন্ড বিক্রি করেছে ৯৮ টাকা ৫২ পয়সা দরে; যা গত বুধবার ছিল ৯৯ দশমিক ৫ পয়সা।
বিদেশি সিটিব্যাংক এনএ আগের কার্যদিবসের চেয়ে রোববার প্রতি পাউন্ড ২ টাকা ৩৮ পয়সা কমে ৯৯ টাকা ৫৫ পয়সা দামে বিক্রি করেছে; যা বৃহস্পতিবার ছিল ১০১ টাকা ৯৩ পয়সা। ইস্টার্ণ ব্যাংক লিমিটেডে (ইবিএল) এদিন পাউন্ড লেনদেন হয়েছে ৯৯ টাকা ৪১ পয়সায়; যা আগের কার্যদিবসের ১০১ টাকা ৬৫ পয়সার চেয়ে ২ টাকা ২৪ পয়সা কম।