মুঘল সাম্রাজ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ আগস্ট ২০১৬, ৩:০১ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন সম্রাট বাবর। তিনি ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কি-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত শাসক। বাবার দিক থেকে তিনি তৈমুর লং ও মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। মধ্য এশিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে বাবর ভারতে ভাগ্য নির্মাণে আসেন।
বাবর নিজেকে কাবুলের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং আফগানিস্তান থেকে খাইবার পাস হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। পানিপথের যুদ্ধে বিজয়ের পর বাবরের সেনাবাহিনী উত্তর ভারতের অধিকাংশ এলাকা জয় করে নেয়। তবে শাসন পাকাপোক্ত করতে অনেক সময় লেগে যায় তার।
অস্থিতিশীলতা তার ছেলে হুমায়ুনের সময়ও ছড়িয়ে পড়ে। হুমায়ুন ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারত থেকে পারস্য পালিয়ে যান। হুমায়ুনের সাথে পারস্যের সাফাভিদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং মুঘল সাম্রাজ্যে পারস্যের সাংস্কৃতিক প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। পারস্যের সহায়তায় হুমায়ুন মুঘলদের ক্ষমতা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন। এর অল্পকাল পরে দুর্ঘটনায় হুমায়ুনের মৃত্যু হলে তার ছেলে আকবর অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় সিংহাসনে বসেন। আকবরের অভিভাবক বৈরাম খান ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করতে আকবরকে সহায়তা করেছেন।
যুদ্ধ ও কূটনীতির মাধ্যমে আকবর সাম্রাজ্যকে সবদিকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। তিনি ভারতের সামাজিক গোষ্ঠীর সামরিক অভিজাতদের থেকে তার প্রতি অনুগত নতুন অভিজাত শ্রেণী গড়ে তোলেন। তিনি উন্নত সরকার ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। আকবর ইউরোপীয় বাণিজ্য কোম্পানিগুলোর সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি করেছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পার্থক্য দূর করার জন্য আকবর দীন-ই-ইলাহি নামক নতুন ধর্ম তৈরি করেছিলেন। তবে এই ধর্ম প্রসার লাভ করেনি।
আকবরের ছেলে সম্রাট জাহাঙ্গীর সমৃদ্ধির সাথে শাসন করেছেন। তবে জাহাঙ্গীর আফিমে আসক্ত ছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় কাজে অনীহা দেখান এবং দরবারের বিদ্রোহীদের প্রভাবে পড়ে যান।
জাহাঙ্গীরের ছেলে শাহজাহানের শাসনকাল মুঘল দরবারের জাকজমকের জন্য প্রসিদ্ধ। এসময় অনেক বিলাসবহুল ইমারত নির্মিত হয়, যার মধ্যে তাজমহল অন্যতম। এসময় দরবারের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ রাজস্ব আয়ের চেয়ে বেশি ছিল।
শাহজাহানের অসুস্থতার পর তার বড় ছেলে দারাশিকো অভিভাবক হন। সিংহাসন নিয়ে শাহজাহানের ছেলেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্যান্যদের পরাজিত করে শেষপর্যন্ত আওরঙ্গজেব জয়ী হন। দারাশিকোকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
আওরঙ্গজেব শাহজাহানকে শাসনের অযোগ্য ঘোষণা করে বন্দী করেন। আওরঙ্গজেবের সময় মুঘল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অনেক বৃদ্ধি পায়। তিনি প্রায় পুরো দক্ষিণ এশিয়া মুঘল সাম্রাজ্যের সরাসরি অধীনে নিয়ে আসেন। ১৭০৭ সালে তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের অনেক অংশ বিদ্রোহ করতে শুরু করে।
আওরঙ্গজেবের ছেলে প্রথম বাহাদুর শাহ প্রশাসন সংস্কার করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তবে ১৭১২ সালে তার মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে। ১৭১৯ সালে চারজন সম্রাট পরপর শাসন করেছেন।
মুহাম্মদ শাহের শাসনামলে সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। মধ্য ভারতের অধিকাংশ মারাঠা সাম্রাজ্যের হাতে চলে যায়। নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করেন এবং এতে মুঘল শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যে অনেক স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়। তবে মুঘল সম্রাটকে সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে বিবেচনা করা হত।
সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম মুঘল কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালান। কিন্তু তাকে বাইরের শক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়। এদের মধ্যে ছিলেন আফগানিস্তানের আমির আহমেদ শাহ আবদালি। ১৭৬১ সালে আবদালির নেতৃত্বাধীন আফগান ও মারাঠা সাম্রাজ্যের মধ্যে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৭৭১ সালে মারাঠারা আফগানদের কাছ থেকে দিল্লি পুনর্দখল করে নেয় এবং ১৭৮৪ সালে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লিতে সম্রাটের রক্ষক হয়ে উঠে। তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই অবস্থা বজায় ছিল। এরপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল রাজবংশের রক্ষক হয়। সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর শেষ মুঘল সম্রাটকে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এরপর ইংল্যান্ডের রাণী ভিক্টোরিয়াকে ভারত সম্রাজ্ঞী ঘোষণা করা হয়।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ
ইতিহাসবিদরা মুঘল সাম্রাজের পতনের বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেন। অর্থনৈতিক দিক থেকে সাম্রাজ্যে প্রধান অফিসার, আমিরদের বেতন দিতে প্রয়োজনীয় রাজস্ব ছিল না। আঞ্চলিক শাসকদের ওপর সম্রাট নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেনাবাহিনীকে অধিক মাত্রায় আগ্রাসী মারাঠাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনব্যপী চলমান যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় ফলে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। ফররুখ সিয়ারের মৃত্যুর পর স্থানীয় শাসকরা ক্ষমতা নিতে শুরু করে।
১৯৭০ এর দশক থেকে ইতিহাসবিদরা বেশ কয়েকভাবে পতনকে ব্যাখ্যা করেছেন। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় দেখা যায় উচ্চশ্রেণীর মধ্যে অসাধুতা, অত্যধিক বিলাসিতা এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি শাসকদের বাহ্যিক হুমকির ব্যাপারে অপ্রস্তুত করে তোলে। একটি মার্ক্সবাদী মতানুযায়ী ধনীদের হাতে কৃষকদের নিপীড়নের কারণে শাসনের প্রতি জনসমর্থন কমে যায়। আরেকটি মতানুযায়ী হিন্দু ধনী সম্প্রদায় মুঘল সাম্রাজ্যের বদলে মারাঠা ও ব্রিটিশদের অর্থসহায়তা প্রদান করে। ধর্মীয় দিক থেকে বিচারে বলা হয় হিন্দু রাজপুতরা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। তবে চূড়ান্ত মত হিসেবে অন্যান্য পণ্ডিতরা বলেন যে, সাম্রাজ্যের অত্যধিক সমৃদ্ধি প্রদেশগুলোকে অধিক মাত্রায় স্বাধীনতা অর্জনে উৎসাহ জোগায় এবং রাজ দরবারকে দুর্বল করে তোলে।