সুরমা নিউজ ডেস্ক:
সিনেমাকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম। সিনেমা শুধু বিনোদনই দেয় না, মাঝেমধ্যে তা বিতর্কেরও জন্ম দেয়। কখনো নগ্নতা-যৌনতার কারণে, কখনও রাজনৈতিক কারণে, মানবিক মূল্যবোধের কারণে কিংবা কখনো ধর্মানুভূতির কারণে, আবার কখনো অতি হিংস্র দৃশ্যের কারণে আলোচিত সিনেমাগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
এমন নিষিদ্ধ হওয়া সিনেমার তালিকা অনেক লম্বা। এই নিষিদ্ধ সিনেমার তালিকায় এমন কিছু সিনেমাও আছে, যেগুলো পৃথিবীর সেরা সিনেমার তালিকাতেও নির্দ্বিধায় জায়গা করে নেবে। স্ক্রিনরেন্ট ওয়েব সাইটের জরিপে বিশ্বসেরা ১০টি নিষিদ্ধ হওয়া সিনেমা নিয়েই আমাদের আজকের এই প্রতিবেদন।
ন্যাচারাল বর্ন কিলারস
অলিভার স্টোন পরিচালিত এই সিনেমাটি ১৯৯৪ সালের ২৬ আগস্ট মুক্তি পায়। সিনেমার কাহিনী এক খুনি দম্পতিকে নিয়ে। তাদের দুজনেরই খুনি হয়ে ওঠার পেছনে আছে দুঃসহ ছোটবেলার স্মৃতি। পরে কেবল আলোচিত সিরিয়াল কিলারই না, আমেরিকার সবচেয়ে আলোচিত দম্পতি হয়ে ওঠে তারা। ক্রাইম-থ্রিলার ঘরানার সিনেমাটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সিনেমাটা দেখে, অনুকরণে একই রকমর কিছু অপরাধও সংঘটিত হয় পরবর্তীতে। এসব দেখেশুনে আয়ারল্যান্ডে নিষিদ্ধ হয় সিনেমাটি। ‘ন্যাচারাল বর্ন কিলারস’ ছবিটিতে অভিনয় করেছেন উডি হ্যারেলসন, জুলিয়েট লিউইস, রবার্ট ডাউনি জুনিয়র সহ অনেকে।
অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ
বিখ্যাত নির্মাতা স্ট্যানলি কুব্রিকের অন্যতম সেরা সিনেমা অ্যা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ মুক্তি পায় ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। মালকম ম্যাকডাওয়েল, প্যাট্রিক ম্যাগি, মাইকেল বিটস অভিনয় করেন এই বিতর্কিত ছবিটিতে। অ্যান্থনি বার্গাসের উপন্যাস অবলম্বনে বানানো যৌনতা আর নগ্নতার দৃশ্যগুলোর জন্য আলোচিত অপরাধ বিষয়ক সিনেমাটি কুব্রিকের জাদুতে সেই দৃশ্যগুলোও অসাধারণ হয়ে ওঠে। সিনেমাটিকে অনেকে পর্নসিনেমা বলতে থাকে। আমেরিকায় এত সহজে ছবিটির মুক্তি মেলেনি। ১৯৯৯ সালে কুব্রিকের মৃত্যুর পর, দীর্ঘ ২৭ বছর পর আবার যুক্তরাজ্যে সিনেমাটি প্রদর্শনের অনুমতি পাওয়া যায়।
দ্য বার্থ অফ এ নেশন
ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯১৫ সালে। এতে অভিনয় করেছেন লিলিয়ান জিয়াস, মে মার্শ, হেনরি বি ওয়াল্টহল সহ অনেকে। হলিউডের ইতিহাসে সিনেমাটি সিনেমাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে সিনেমাটিতে বর্ণবাদের মত সংবেদনশীল প্রসঙ্গ রয়েছে। বিশেষ করে এক আফ্রিকান নিগ্রো চরিত্রকে অতিরিক্ত যৌন আসক্ত চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়, তা অনেক বেশি বিতর্কের সৃষ্টি করে। সিনেমাটি মুক্তির পর বিতর্কের ঝড় ওঠে। এমনিতেই তখন বর্ণবাদ বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় ছিল বিশ্ব। ফলে শিকাগো, মিনেসোটার মতো রাজ্যগুলোতে সিনেমাটি মুক্তির ছাড়পত্র পায়নি।
দ্য এক্সরসিস্ট
১৯৭৩ সালের ১৯ জুন মুক্তি পায় হরর সিনেমাজগতের অন্যতম সেরা সিনেমা ‘দ্য এক্সরসিস্ট’। সিনেমাটি পরিচালনা করেন উইলিয়াম ফেড্রিক। ৪০ দশকে ব্রিটিশ পাদ্রি রোল্যান্ড ডো-র শয়তানের উপাসনা করার খবর ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল সে সময়। তারই এক ঘটনার অনুকরণে উইলিয়াম পিটার ব্ল্যাটি একই নামের একটি উপন্যাস লেখেন। পরে সেখান থেকেই সিনেমাটি বানানো হয়। আর বানানোর সময় একের পর এক দুর্ঘটনায় এমন গুজবও ছড়িয়ে পরে যে, সিনেমাটাই অভিশপ্ত। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিনেমাটি মুক্তি পায়। আস্তে আস্তে দর্শকপ্রিয়তাও পেতে থাকে। সিনেমাটি এক সময় হরর সিনেমার সবচেয়ে আয় করা সিনেমাগুলোর কাতারে ঢুকে পরে। তবে প্রযোজনা সংস্থা ওয়ার্নার ব্রাদার্সের নিষেধাজ্ঞার ভয়ে সিনেমাটির ভিডিও কপি ব্রিটেনের বাজারে ছাড়া হয় ১৯৮৪ সালে। পরে ১৯৮৬ সালে সিনেমাটি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ১৯৯৯ সালে সিনেমাটি আনকাট ছাড়পত্র পায়। এতে অভিনয় করেন এলেন বার্সতিন, ম্যাক্স ভন সিড্যো, লী জে কব, কিটি উইন, জ্যাসন মিলার, লিন্ডা ব্লেয়ার সহ অনেকে।
দ্য টেক্সাস চেইন স ম্যাসাকার
এখন এই সিনেমাটিকে অন্যতম ক্ল্যাসিক হরর সিনেমার স্বীকৃতি দেয়া হয়। পরে সিনেমাটির আরও পাঁচটা সিক্যুয়াল নির্মিত হয়েছে। সিনেমাটি যখন মুক্তি পায়, তখন সিনেমাটির নৃশংসতা সবার কাছে আপত্তি তুলেছিল। হরর সিনেমার গল্পের এক নতুন ধারা উন্মোচন করে ‘দ্য টেক্সাস চেইন স ম্যাসাকার’ ছবিটি। সিনেমাটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল বলে আরও বেশি আপত্তির ঝড় ওঠে। কিন্তু পরে জানা যায়, এমন ভয়ংকর কোনো ঘটনা আসলে ঘটেনি। আসলে একটি খুনের ঘটনা থেকে সিনেমাটির পটভুমি নেয়া হয়। সিনেমাটি ব্রিটেন, জার্মানি, ব্রাজিল, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কিছু দেশেই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ্য, টোব হুপার পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৪ সালে। মেরিলিন বার্নস, পল অ্যা পার্টেইন, অ্যাডউইন নীল, টেরি ম্যাকমিন সহ অনেকে অভিনয় করেছেন ‘দ্য টেক্সাস চেইন স ম্যাসাকার’ ছবিটিতে।
ইন্ডিয়ানা জোন্স এন্ড দ্য টেম্পল অফ ডুম
বিশ্বসেরা নির্মাতা স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত ইন্ডিয়ানা জোন্স সিরিজের দ্বিতীয় সিনেমা ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স এন্ড দ্য টেম্পল অফ ডুম’ ১৯৮৪ সালের ২৩ মে মুক্তি পায়। পরিচালক স্পিলবার্গ স্বীকার করেন ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’ সিরিজের অন্যান্য সিনেমাগুলোর চেয়ে এটি একটু বেশিই হিংস্র। সিনেমাটি আমেরিকায় পিজি-১৩ ক্যাটাগরিতে কিভাবে জায়গা করে নিল, তাই নিয়েও বেশ আলোচনা হয়েছিল সে বছর। তবে সিনেমাটির নিষেধাজ্ঞার কারণ অন্য। সিনেমাতে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং হিন্দু ধর্ম বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে- এই যুক্তিতে সিনেমাটিকে ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে অবশ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। হ্যারিসন ফোর্ড, কেট ক্যাপশো, ফিলিপ স্টোন, ভারতের অমরিশ পুরি এবং রোশান শেঠ অভিনয় করেন এই সিনেমায়।
ক্যানিবল হলোকাস্ট
১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি মুক্তি পায় সর্বকালের অন্যতম বিতর্কিত সিনেমা ‘ক্যানিবল হলোকাস্ট’। এর কাহিনি মূলত আমাজনের ক্যানিবল তথা নরখাদক গোত্রদের নিয়ে। রজারো দেওদাতো পরিচালিত ছবিতে অভিনয় করেন রবার্ট কারম্যান, ফ্রান্সেস্কা চারডি, পেরি পেরকানেন সহ অনেকে।
সিনেমার কাহিনী এমন, আমাজনের নরখাদক গোত্রদের উপর ডকুমেন্টারি বানাতে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় চার জনের একটি দল। তাদের উদ্ধারে অভিযানে নামে আরেকটি দল। উদ্দেশ্য, ওই চারজন এবং তাদের ধারণকৃত ফুটেজ উদ্ধার করা। কিন্তু আপত্তিকর নৃশংস দৃশ্য দেখানোর দায়ে সিনেমাটি ইতালি, অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় সব দেশেই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এমনকি পরিচালক রজারো দেওদাতোর বিরুদ্ধে সেই নিরুদ্দেশ চার অভিনেতাকে খুনের দায়ে মামলা করা হয়। তাকে প্রকাশ্যে ব্যাখ্যা করতে হয়, কীভাবে এতটা বাস্তবধর্মী দৃশ্য দেখানো হল। পরে তিনি সিনেমার সকল অভিনেতাদের আদালতে হাজির করে তবেই মুক্তি পান। তবে সিনেমাটিতে প্রাণীদের অত্যাচার করার জন্য মামলায় শাস্তি পেতে হয় তাকে।
দ্য লাস্ট টেম্পটেশন অব খ্রাইস্ট
মার্টিন স্করসিস পরিচালিত এই সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৮৮ সালের ১২ আগস্ট। নির্মাণের দিক দিয়ে মাস্টারক্লাস হলেও গল্পটি ছিল স্পর্শকাতর। ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত দেয়ার কারণে তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, মেক্সিকো, চিলি এবং আর্জেন্টিনাতে নিষিদ্ধ হয় ছবিটি। সিনেমাটিতে যীশুর চরিত্র দেখানো হয়েছে, যাতে দেখানো হয়েছে তার মানবীয় দোষ-ত্রুটি লোভ-লালসা ভয়-ক্রোধ-ভালোবাসা। বিশেষ করে মেরি ম্যাগডালিনের সঙ্গে যীশুর ভালোবাসা তো বটেই, শারীরিক সম্পর্কও দেখানোটা রক্ষণশীল খ্রিষ্টানরা মোটেই ভালো ভাবে গ্রহণ করেনি। আর তা একেবারেই সহ্য করতে পারেনি বেশ কিছু দেশের সেন্সর বোর্ড।
দ্য ভিঞ্চি কোড
২০০৬ সালের ১৯ মে মুক্তি পায় ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ ছবিটি। এটি পরিচালনা করেছেন রন হাওয়ার্ড। টম হ্যাংকস, জিন রেনো, পল বেটানি, আলফ্রেড মলিনা, আইয়ান ম্যাককেলেন সহ অনেকে অভিনয় করেন বিখ্যাত এই সিনেমায়। ড্যান ব্রাউনের রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের এই বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই বেশ বিতর্কিত হয়েছিল। অনেক দেশে নিষিদ্ধও হয়েছিল। কাজেই হোলি গ্রেইল, ওপুস দেই, যীশুর উত্তরসূরীর মতো সংবেদনশীল বিষয় ঘিরে আবর্তিত এই থ্রিলার সিনেমাটিও যে রক্ষণশীল খ্রিষ্টানদের কারণে নিষিদ্ধ হবে, তা খুবই স্বাভাবিক। মিশর, জর্ডান, লেবানন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোতেও নিষেধের আওতায় পড়েছিল সিনেমাটি।
মন্টি পাইথন’স লাইফ অফ ব্রায়ান
১৯৭৯ সালে মুক্তি পায় ‘মন্টি পাইথন’স লাইফ অফ ব্রায়ান’ ছবিটি। টেরি জোন্সের পরিচালনায় ছবিটিতে অভিনয় করেছেন গ্রাহাম চাপম্যান, জন ক্লিস, টেরি গিলিয়াম, মাইকেল পলিন এবং ছবির পরিচালক নিজে। ব্রিটেনের কমেডি সিনেমার জগতের বিটলস বলা হয় মন্টি পাইথন গ্রুপটিকে। তাদের কাহিনী ও পরিচালনায় কমেডি ধাঁচের সিনেমাগুলো বেশ কৌতুকাবহপূর্ণ। আর এই হাস্যরস সৃষ্টি করতে গিয়ে প্রতিটি সিনেমাতেই তারা কোনো না কোনো বিতর্ক উস্কে দিতেন। বিতর্ক যখন যীশুকে নিয়ে, তখন খ্রিষ্টানদের ব্যাপারটা হজম করতে কষ্টই হয়। তেমনটাই হয়েছে এই সিনেমাটিতে। সিনেমাটির মূল চরিত্র ব্রায়ান যীশুর সাথে একই দিনে একই সময়ে একই ভাবে জন্মায়। ওদের জন্মও হয় পাশাপাশি বাসায়। আর যীশুর সাথে তার এত মিল থাকায় যে সমস্যা হয়, তাকে প্রায়ই মানুষজন যীশুর সাথে গুলিয়ে ফেলে। সব মিলিয়ে সিনেমাটির বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ ওঠে। আর সেই অভিযোগে ব্রিটিশ এই সিনেমাটি সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চলেই নিষিদ্ধ হয়। এমনকি নরওয়ে, আয়ারল্যান্ডের মতো উদার হিসেবে পরিচিত দেশগুলোও সিনেমাটিকে ছাড়পত্র দেয়নি।