গুলশান হামলাঃ মাস্টারমাইন্ডের খোঁজে গোয়েন্দারা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জুলাই ২০১৬, ৬:১৮ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজঃ
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় অংশ নেয়া জঙ্গিদের মাস্টারমাইন্ডদের সন্ধানে গোয়েন্দারা মাঠে নেমেছে। তাদের ধরতে রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে প্রায় প্রতিদিনই অভিযান চলছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এই গ্রুপটিই গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে আসছিলো। এই গ্রুপের সদস্যরা বেশির ভাগই জেএমবি এবং আনসারুল্লাহ টিমের সদস্য। তারা নতুন একটি দল গঠন করে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলো। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলাসহ অন্যান্য হামলার মাস্টারমাইন্ড এই ব্যক্তি উচ্চ শিক্ষিত ও আইটি বিষয়ে অভিজ্ঞ বলে জানা গেছে। গোয়েন্দারা তার অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা করছেন। একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সে ঢাকার একটি অভিজাত এলাকায় বসে কর্মীদের সংগঠিত করেছেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এই দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সম্পর্কে তারা তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাদের নজরদারির মাধ্যমে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে যে পাঁচ জঙ্গি অংশ নিয়েছিলো তারা প্রত্যেকেই রাজধানীর একটি বাসায় অবস্থান করতো। এখানে বসেই জঙ্গিরা গুলশানের হামলার পুরো ছক আঁকে। তবে প্রশিক্ষণের জন্য তারা ঢাকার উপকণ্ঠ ও উত্তরাঞ্চলের একটি জেলা শহরে যাতায়াত করতো। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এসব বাসা ও স্থান চিহ্নিত করেছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘটনার দিন জঙ্গিরা ইফতারের সময়টি বেছে নিয়ে গুলশানের কূটনৈতিকপাড়ায় প্রবেশ করে। ওই সময় কূটনৈতিকপাড়ার বিভিন্ন সড়কের নিরাপত্তার দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা ইফতার করতে বসতেন। একারণে ইফতারের কিছু সময় তল্লাশি চৌকি ঢিলেঢালা থাকতো। এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়েছে জঙ্গিরা। পাঁচ জঙ্গিই পৃথক পথে ৭৯ নম্বর সড়কের কাছে গিয়ে মিলিত হয়। তারপর পায়ে হেঁটেই তারা হোটেল আর্টিজানে প্রবেশ করে। গুলশান এলাকার সকল সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পেয়েছেন বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর সেখান থেকে অন্যান্য আলামতসহ ৩০টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। এসব মোবাইল ফোন চেক করে কিছু তথ্য পাওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে। জঙ্গিরা দেশি-বিদেশি ২০ জনকে হত্যার পর নিহতদের একজনের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবি তুলে তাদের মাস্টারমাইন্ডের কাছে পাঠায়। সূত্র জানায়, ‘থ্রিমা’ নামে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে তারা এসব তথ্য পাঠিয়েছে বলে অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছেন তারা। সূত্র জানায়, জঙ্গিরা ঘটনাস্থলে থেকেই থ্রিমা অ্যাপসটি ডাউনলোড করে ছবি ও তথ্য পাঠিয়ে তা আবার আনইনস্টল করে দেয়। ফরেনসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে থ্রিমায় পাঠানো পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হামলার ঘটনায় সম্পৃক্তরা সবাই আইটি বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলো। হামলার আগেই মাস্টারমাইন্ড তাদের এই প্রশিক্ষণ দেয়। এরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগও করে থ্রিমাসহ বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করে। এসব সফটওয়্যার ব্যবহার করে যোগাযোগের কারণে তাদের গোপন কোনো তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নজরদারি করতে পারে না। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক হামলায় অংশ নেয়া এই জঙ্গি গ্রুপটি পুরো যোগাযোগসহ সদস্য রিক্রুটিং এবং অন্যান্য কাজকর্ম অনলাইনের মাধ্যমে করতো। তাদের টার্গেট থাকে উচ্চ শিক্ষিত ও ধর্মীয় ভাবাপন্ন তরুণদের। কৌশলে তাদের প্রলুব্ধ করা হয়। জঙ্গি নেতাদের হাতে মোটিভেট হয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কিছু তরুণ পরে আবার ফিরেও এসেছে। এমন কয়েকজন তরুণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা কথা বলেছে। এই তথ্য জানিয়ে গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, নিজেদের দলে ভেড়ানোর পর শীর্ষ নেতারা কথিত জিহাদের জন্য পরিবারের মায়া ত্যাগ করার চাপ দেয়। যারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি তারাই পালিয়ে এসেছে। তবে দলে ভেড়ানোর পর ফিরে গেলে জিহাদের স্বার্থেই তাকে হত্যা করা হবে বলেও ভয় দেখানো হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, মাস্টারমাইন্ডদের আইনের আওতায় আনতে পারলেই ৯০ ভাগ জঙ্গি কার্যক্রম প্রতিরোধ করা যাবে।
একদিন আগেই গোয়েন্দা রিপোর্ট দেয়া হয়েছিলো: গত ১লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার একদিন আগেই ৩০শে জুন পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছিলো। ওই প্রতিবেদনে ঢাকাসহ দেশের অপর দুটি জেলায় বড় ধরনের কোনো হামলার আশঙ্কা করা হয়। সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ টহলসহ তল্লাশি চৌকিও বাড়ায়। তবে নির্দিষ্ট কোনো স্থানে হামলা হতে পারে সে বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা না থাকায় গুলশানের হামলা ঠেকানো সম্ভব হয়নি। তবে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে হামলাকারী হিসেবে ৫ জঙ্গির সাংগঠনিক নামও উল্লেখ করা হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তারাও জঙ্গিদের বড় হামলার আশঙ্কা করছিলেন। একারণে চিহ্নিত কিছু জঙ্গি সদস্যকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছিলেন।
নিবরাসের সহযোগীদের ধরে চাপে ছিলো পুলিশ: গুলশানের জঙ্গি হামলায় অংশ নিয়ে নিহত হওয়া নিবরাসের সহযোগীদের ধরে চাপে ছিলো ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তারা হলো- রাইয়ান মিনহাজ ওরফে রাইজু ওরফে আরমিন (২৪), আহমেদ শাম্বুর রায়হান ওরফে চিলার (২৩) ও তৌহিদ বিন আহমেদ ওরফে রিয়াজ (২৪)। এরা সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, গত ৯ই ফেব্রুয়ারি এই তিন তরুণকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। ওই দিন শাহবাগ থানায় তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। তাদের কাছ থেকে জঙ্গি নিবরাসসহ অন্য আরো অনেকের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রেপ্তারের পর এই তিন জনকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের নানা লোকজন তদবির শুরু করেন। এই তরুণেরা যে জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত তা তারা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চায়নি। উল্টো গ্রেপ্তারের সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের নানাভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা করা হয়েছে। পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, তারা নিশ্চিত হয়েই এই তরুণদের গ্রেপ্তার করেছিলেন।
গত ১লা জুলাই শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর প্লটের স্প্যানিশ রেস্তরাঁ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। অস্ত্রধারী জঙ্গিরা রেস্তরাঁয় অবস্থান করা ১৭ বিদেশি নাগরিক, একজন বাংলাদেশ ও আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক ও দুই বাংলাদেশিকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। জঙ্গিরা হোটেলে আসা দেশীয় নাগরিক ও রেস্তরাঁ কর্মচারীদের জিম্মি করে রাখে। পরদিন সকাল সাড়ে ৭টায় সেনাবাহিনীর কমান্ডো সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ভেতর থেকে ১৩ জিম্মিকে উদ্ধার করে। অভিযানের সময় কমান্ডোদের গুলিতে ৫ অস্ত্রধারী জঙ্গি ও এক রেস্তরাঁ কর্মচারী নিহত হয়। এছাড়া, জঙ্গি হামলার শুরুতেই প্রতিরোধ করতে গিয়ে পুলিশের একজন সহকারী কমিশনার ও একজন পরিদর্শক নিহত হন। আহত হন অন্তত ৩২ পুলিশ সদস্য। এসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হোটেল কর্মচারীসহ ১৯ জনকে উদ্ধার করে। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ এক হোটেল কর্মচারী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।