ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে থাকতে রুশনারা আলীর খোলা চিঠি
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুন ২০১৬, ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ
সুরমা ডেস্কঃ বাসিন্দা, প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন থেকে শুরু করে লেবার লিডার জেরিমি করভিন, সকল প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে লন্ডন মেয়র সাদিক খান, বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা থেকে শুরু করে প্রায় সকল বিশ্ব নেতা, সর্বোপরি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর, অর্থনীতিবিদ, শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, বিজ্ঞানী, গবেষক সবাই এক বাক্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ব্রিটেনের থাকার পক্ষে মতামত দিচ্ছেন ।
আমার মতামতও হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যেই ব্রিটেন সবদিক দিয়ে শক্তিশালী, নিরাপদ এবং ভালো। আমাদের এই সম্মিলিত মতামত শুধু কথার কথা অথবা বিশ্বাস অথবা আবেগ থেকে নয়, এর পিছনে যথেষ্ট বাস্তবসম্মত এবং যৌক্তিক কারণ বিদ্যমান।
কারণ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বহু সুফল আমরা প্রতিদিনই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ভোগ করছি। অন্যদিকে, যারা ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে ক্যাম্পেইন করছেন তারা কিন্তু কথার ফুলঝুরি ছাড়া বলতে পারছেন না ব্রিটেন ইউনিয়ন ছেড়ে চলে আসলে কী হবে। অর্থ ইউনিয়ন পরবর্তী রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কে বিশদ কোন পরিকল্পনাই তাদের টেবিলে নেই। এমনকি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া সামলানোর ধারনাও তাদের নেই। অথচ স্মরণকালের মধ্যে আমাদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
তাই বলবো, আমরা যদি বাস্তবতাকে মানি তাহলে ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে ভোট দেয়া মানেই আমাদের অর্থনীতির জন্য অনিশ্চয়তা এবং অস্থিরতা ডেকে আনা। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের বর্তমান গভর্নরের ভাষায় যার অন্য অর্থ হচ্ছে আরেকটি দীর্ঘ মেয়াদী অর্থনৈতিক মন্দা বা রিসেশন।
আর এটা হলে অর্ধ মিলিয়ন মানুষ শুধু চাকুরীই হারাবেন না, পাউন্ডের মূল্যও আনুমানিক ৩.৬% কমে আসবে। অন্যদিকে ইউনিয়ন ত্যাগ করলে মানুষের আয় কমে আসার পাশাপাশি দোকানে জিনিসপত্রের কম দামে আঘাত আনার আশংকা থেকে যাবে, যা বছরে পরিবার পিছু বার্ষিক ৩৫০ পাউন্ড সাশ্রয় কমিয়ে দিতে পারে। আর এজন্যই পরিসংখ্যান এবং প্রমাণ সাপেক্ষে এই গণভোটের সিদ্ধান্ত হওয়াটা জরুরী।
পরিসংখ্যান হচ্ছে, ব্রিটেনের ৩ মিলিয়ন চাকুরী ইইউ বাণিজ্যের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। পরিসংখ্যান হচ্ছে, ইইউ দেশগুলো থেকে প্রতিবছর গড়ে ২৪ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ হয় এদেশে। ইইউ এর সদস্য হওয়ার কারণেই ব্রিটেন বিশ্বের সবচাইতে বড় বাণিজ্যিক ব্লকের সদস্য।
সন্দেহ নেই ব্রিটেন ইইউ থেকে বের হয়ে গেলে এর সব কিছুই উলট পালট হয়ে যাবে। বাণিজ্যিক সুবিধার বাইরে ইইউ মেম্বারশিপই আমাদের মিনিমাম পেইড লিভ, এজেন্সি ওয়ার্কারদের বিভিন্ন অধিকার, পেইড ম্যাটারনিটি এবং প্যাটারনিটি লিভ, বেতনে সমতা, ধর্ম এবং বর্ণ বৈষম্য থেকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইইউ ইউরোপের শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্যও কাজ করছে। আমরা অস্বীকার করতে পারবো না যে, ইইউ ত্যাগের পক্ষের ক্যাম্পেইনারদের মধ্যে অনেকেই উগ্র ডানপন্থী এবং বিভক্তি সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদ। অনেকেই ইসলামোফোবিক এবং বর্ণবাদী ভাষা ব্যবহার করেন। তাদের একজন হচ্ছেন নাইজেল ফারাজ।
তিনি ব্রিটেনের এথনিক এবং মুসলিম কমিউনিটি সম্পর্কে প্রায়ই বাজে মন্তব্য করে থাকেন। যে কোন সমস্যায় ইমিগ্র্যান্টদের উপর দায় চাপানোর অলস মানসিকতা তার মতো লোকদের মনে কাজ করে। তারা ইমিগ্র্যাশনের নেতিবাচক দিককে তিলকে তাল করে বলতে যতোটা না আগ্রহী, সুফলের কথা বলতে ততোটা আগ্রহী নন। ইইউ ত্যাগ করলে তিনি এবং তার বন্ধুরা কখনোই ইমিগ্র্যান্টদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবেন না।
ভিন্ন ভিন্ন কমিউনিটির মানুষ এক সাথে থেকে কিভাবে নিজেদের এবং সমাজের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে এর বড় উদাহরণ হচ্ছে আমার নির্বাচনী এলাকা বেথনাল গ্রিন এন্ড বো। অথচ ইইউ ত্যাগের পক্ষে ক্যাম্পেইন পরিচালনাকারীরা ইমিগ্র্যাশনের তথ্য বিকৃত করে সমাজে ভয় এবং অসহিঞ্চুতা সৃষ্টি করছেন। এই মুহুর্তে এনএইচএস লন্ডনেই ইইউ দেশগুলোর ১৬ হাজার ৮শ স্টাফ কর্মরত রয়েছেন। যার মধ্যে ২ হাজার ৮শ ডাক্তার এবং ৬ হাজার ৯শ নার্স রয়েছেন।
ইইউ ত্যাগ মানেই এই গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিসে লোক নিয়োগে বিশাল প্রতিবন্ধকতা। দক্ষ-অদক্ষ কর্মী থেকে শুরু করে, ডাক্তার, নার্স সব ক্ষেত্রেই ইমিগ্র্যান্টরা আমাদের দেশের জন্য ইতিবাচক প্রভাব রেখে আসছেন। ইইউ ত্যাগের পক্ষের লোকজন প্রচার করছেন যে, ইইউ ইউরোপের বাইরের দেশের লোকজনের ইমিগ্র্যাশনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা একেবারেই ভুল তথ্য। অফিস অব ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস এর পরিসংখ্যান তাদের প্রোপাগান্ডাকে মোটেই সাপোর্ট করে না। এছাড়া ইইউ কমনওয়েলথ এর সাথে আমাদের সম্পর্ককে জোরদার করে চলেছে। ইইউ এর কারণেই ১৯টি কমনওয়েলথ দেশের সাথে আমাদের বিশেষ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে যা আমাদের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মতে ব্রিটেন হচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে আমাদের প্রবেশ দ্বার।
ইইউ এর সদস্য হওয়ার কারণেই বহু বিষয় আমরা সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করে আসছি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ট্যাক্স ফাঁকি, জলবায়ু সমস্যা, মাইগ্র্যাশন সমস্যা, সন্ত্রাস ইত্যাদি। এসব আন্তর্জাতিক ইস্যু এখন আমরা আর এককভাবে মোকাবেলা করতে পারবো না। এক কথায় আমরা চাই বা না চাই বিশ্ব বদলে গেছে বহু আগেই। বদলে গেছে আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের ধারনাও। এর সাথে পাল্লা দিতে না পারলে আমরাই ছিটকে পড়বো। কোন ঐতিহাসিক ভুল যাতে আমাদেরকে পিছনে ঠেলে না দেয়।
২৩ জুনের গণভোট তাই আমাদের জন্য, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আসুন সবার মঙ্গলের জন্য আমরা ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট দেই।
রুশনারা আলী হচ্ছেন বেথনাল গ্রিন এন্ড বো আসনের এমপি এবং বাংলাদেশে ব্রিটেনের বিশেষ বাণিজ্যদূত।