বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল : শুদ্ধব্রত তরুণ স্বপ্নচারী
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ৫:৫৬ অপরাহ্ণ
আশরাফ হাসান:
তারুণ্যদীপ্ত, সময়ের এক ব্যস্ত লেখক ও প্রকাশক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল। নানাবিধ পরিচয়কে ধারণ করেছেন আপন প্রতিভা, নিরলস কর্মনিষ্ঠা আর সৃষ্টিশীলতার বৈচিত্রময় কর্মযজ্ঞে। সত্য-সুন্দরের প্রতি আজন্ম কমিটেড এ তরুণ। একইসঙ্গে স্বাপ্নিক ও কর্মবীর। কথা ও কাজের বিস্তর ফারাক ঘুচিয়ে অভীষ্ট মঞ্জিল পানে ধাবমান তার শৈল্পিক সাম্পান। কাজে ক্ষীপ্র, স্বভাবে মহৎপ্রাণ, অতি বিনয়ী। আদর্শজাত মানবিক বোধের লালন তার মজ্জাগত অনুধ্যান। খেদমতে খাল্ক তথা মানবসেবা, সৃজনশীলতার পাশাপাশি তাঁকে দিয়েছে বিশিষ্টতা। নিরন্তর সাহিত্যচর্চার সমান্তরালে মৌলিক গ্রন্থ রচনা, সম্পাদনা ও প্রকাশনায় ইতোমধ্যে লেখক-পাঠক ও প্রাজ্ঞজনের সুদৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন।
দুই.
বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সলের জন্ম ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর, নালিউরি গ্রামে। পিতা মরহুম মোহাম্মদ আবদুন নূর ও মাতা ফরিজা খাতুন। নয়-এর দশকে একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পী হিসেবে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশ ঘটে। বিভিন্ন সাহিত্য আসর, আড্ডা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হাজিরা দিতে থাকেন হৃদ্যিক আকর্ষণে। আদর্শবিশ্বাস ও দেশাত্মবোধ তাকে মৌলিক সাহিত্যসাধনা ও প্রকাশনা শিল্পের মূলস্রোতে একাত্ম করে। মধ্যখানে সাংবাদিকতা করেছেন, ফ্রিল্যান্স লিখছেন এখনও। সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘পা-ুলিপি’ সম্পাদনার পথ ধরেই তার সাহিত্যকর্মের বিস্তৃতি নিবিড়তা
‘পা-ুলিপি’র পথচলা শুরু ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে। এরপর তার নেপথ্য ভূমিকা ও সম্পাদনায় এটি সিলেটসাহিত্যে ঐতিহ্যের লালন ও শেকড়মুখি প্রয়াসে ভিন্নমাত্রার সংযোজন ঘটায়। পা-ুলিপি’র উদ্যোগে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘ক্যামেরার চোখে মহাদুর্যোগ’ যা অনুভূতিপ্রবণ সুধীজনকে বেশ নাড়া দেয়। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের বইমেলায় অংশগ্রহণ করে পা-ুলিপি নবীন-প্রবীন লেখকদের সম্মিলনের আয়োজন করে। বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল গড়ে তোলেন ‘পা-ুলিপি প্রকাশন’। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এটি সাহিত্য ও প্রকাশনাশিল্পে নবতর আমেজ ও সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। ইতোমধ্যে এ প্রতিষ্ঠান থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রকাশনা সর্বস্তরের লেখক-পাঠক, সাহিত্যামোদী এবং বিদগ্ধজনকে আকৃষ্ট করেছে। প্রকাশনাশিল্পে ‘সেকেলে’-অনগ্রসর সিলেটে পা-ুলিপিএকটি সফল আন্দোলনের সম্ভাবনাময় চারাগাছ’এমনটি বলা অত্যুক্তি হবে না। পা-ুলিপি কেবল প্রকাশনাবাণিজ্যে প্রকাশনা নয়,‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ আজন্ম প্রত্যয়ী এবং প্রতিভাবান লেখক-সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় উদারমনস্ক।
এরই ধারাবাহিকতায় ‘পা-ুলিপি প্রকাশন’ এর কর্ণধার বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল কয়েকটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে সুধী-বোদ্ধাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এঁদের মধ্যে সাড়া জাগানো প্রাচীন উপন্যাস আর্জুমন্দ আলী রচিত ‘প্রেম-দর্পণ’ (ফেব্রুয়ারি ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ), আবদুল মালিক চৌধুরী রচিত ‘পরদেশী’ (আগস্ট ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ) ও ‘নূতন ইমাম’ (২০১১ খ্রিস্টাব্দ) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া অনুবাদ ও সম্পাদনায় তার পরিচ্ছন্ন হাতের ছোঁয়া লেগেছে। ইসলামি বিষয়ভিত্তিক‘আপনার ঈমান কি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য? (সংশয় নিরসন)’ (অক্টোবর ২০১১ খ্রিস্টাব্দ), ‘প্রত্যেক মুসলিমের যেসব বিষয় জানা ওয়াজিব’ (অক্টোবর ২০১১ খ্রিস্টাব্দ) প্রভৃতি গ্রন্থে। তার প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান থেকে বহুল আলোচিত হারূন আকবর রচিত ‘আভিজাত্যে সিলেটী সমাজ’-সহ বহুসংখ্যক গ্রন্থ ও প্রকাশনা ইতোমধ্যে সুধী-পাঠকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।
এ নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্যসেবীর লেখা গ্রন্থের সংখ্যা সাতটি। অথচ এ অল্পায়তন পাত্রে বিশাল জ্ঞানভা-ারের অমেয় নির্যাসকে ধারণ করার কুশলতা ও পারঙ্গমতা উভয়টিই তার রয়েছে। তাই তার রচিত মৌলিক গ্রন্থ মানুষের অনন্ত জীবন (২০১০ খ্রিস্টাব্দ), শিলচর ভ্রমণের আনন্দস্মৃতি (২০১৩ খ্রিস্টাব্দ), সিয়াম সাধনার ফজিলত ( ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ) মুসলিম জীবনে বিয়ে ও দাম্পত্য (২০১৪ খ্রিস্টাব্দ), পার্থিবজীবনে লোভের পরিণতি (২০১৪), মনের মুকুরে দাগকাটা মুখ (২০১৮ খ্রিস্টাব্দ), বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের গৌরবগাথা (২০১৯ খ্রিস্টাব্দ) ও সফলতার থ্রিডাইমেনশন (২০২০ খ্রিস্টাব্দ) দেশ ও বিদেশে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে। এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন বাংলাসাহিত্যের প্রাচীন উপন্যাস ‘ প্রেমদর্পণ’(২০০৮ খ্রিস্টাব্দ), আবদুল মালিক চৌধুরীর ‘পরদেশী’(২০০৮ খ্রিস্টাব্দ),প্রত্যেক মুসলিমের যেসব বিষয় জানা ওয়াজিব (২০১১ খ্রিস্টাব্দ), আপনার ঈমান কি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য (২০১১ খ্রিস্টাব্দ), হাদিস বর্ণনাকারী একশত সাহাবী এবং বিখ্যাত গ্রন্থসমূহ (২০১১ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর সম্পাদিত স্মারকগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, সময়ের আলোয় হারূণ আকবর (২০১৩ খ্রিস্টাব্দ)।
তোরা চাস্নে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।
কবি ফররুখ আহমদের আদর্শের অনুগামী বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল প্রকাশনাশিল্পে সিলেটকে ‘নিজের পায়ে দাঁড়া’তে কাজ করে যাচ্ছেন অবিশ্রাম যতিহীন। এখানে কয়েকটি গ্রন্থের আলোচনা তুলে ধরার মাধ্যমে লেখকের সাহিত্যচর্চার একটি সার্বিক পরিচয় ফোটে ওঠবে আশা করছি।
তিন.
‘রুহ’ বা আত্মার মৃত্যু নেই। মৃত্যুর অনিবার্য বাহনে চড়ে আত্মা স্থানান্তরিত হয় মাত্র। দুনিয়ায় ‘রুহ’ দেহকে অবলম্বন করেÑখাঁচার পাখির মতো বন্দিত্বে, পরাধীনতায় গ্লানিবিদ্ধ হয়। আল কুরআনের ঘোষণা ‘প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে (আ’ল-ইমরান : ১৮৫)।’ মৃত্যুর এ স্বাদ গ্রহণের মধ্যদিয়েই মু’মিনের আত্মা এক অব্যক্ত পেরেশানি আর নিñিদ্র বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করে। তাই প্রকৃত মু’মিন পূর্ণপ্রস্তুতির সাথে কাক্সিক্ষত মৃত্যুর এন্তেজার করেন। মৃত্যুপরবর্তী অনন্ত সুখের বেহেশতি জিন্দেগি কামনা করেন। ‘তাওয়াফ্ফানী মুসলিমা’‘মুসলিম হিসেবে আমাকে স্থানান্তরিত করো’ দিলের এমন প্রার্থনায় দিন গুজরান করেন অধীর প্রতীক্ষায়।
এমন প্রতীক্ষা তাঁরাই তো করতে পারেন যাঁরা পূর্ণ ঈমানদার, পরকালীন জীবনের জন্যে যাঁরা পর্যাপ্ত পাথেয় সংগ্রহ করতে সক্ষম। আখেরাতের পাথেয় উপার্জন এবং প্রকৃত মু’মিন হওয়ার জন্যে পরিশুদ্ধ বিশ্বাস, জীবনপদ্ধতি ও সৎকর্ম সম্পাদন সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ অতি জরুরি। এ অনুভূতি থেকেই বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল পরকালীন অনন্ত সুখময় জীবনের দিকে আহ্বান করেছেন তার ‘অনন্ত জীবন’ গ্রন্থের ভাষা ভাষ্যের মাধ্যমে। কুরআন ও হাদিসের দালিলিক ও তাত্ত্বিক উপস্থাপনা সমৃদ্ধ গ্রন্থটিতে মুসলিম জীবনের অত্যাবশ্যকীয় ইল্ম (জ্ঞান), আমল (কর্ম) ও আক্বীদা (বিশ্বাস) বিষয়ক মৌলিক, বলিষ্ঠ আলোচনা সন্নিবেশিত হয়েছে। গ্রন্থের বিষয়বস্তু নির্বাচন ও বিন্যস্তকরণে লেখক দূরদর্শী চিন্তা এবং দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। গ্রন্থের ভাষা সহজবোধ্য-সাবলীল, বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টিশীল, ‘ক্লাসিক’ ও শিল্পসুন্দর। মূলত সত্য-সুন্দরের অনুসন্ধিৎসা, আল্লাহর সন্তষ্টি প্রাপ্তির স্পৃহা লেখককে গ্রন্থ রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে। গ্রন্থে লেখক যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন সেগুলো হলো আল্লাহর পরিচয়, সৃষ্টির রহস্য, মানুষের পরিচয়, ইসলামী আকীদা, আল্লাহর প্রতি ঈমান, ঈমানের মাধুর্য, তাওহীদ, র্শিক, সুন্নাহ ও বিদ’আত, কুফ্র, জাহেলিয়াত, ইসলাম বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ, শয়তানের স্বরূপ ও তার কুমন্ত্রণার প্রয়োগ পদ্ধতি, আলওয়ালা ওয়াল বারা, তাওবা, দোয়া, মৃত্যু, কবর, জান্নাত ও জাহান্নাম, মুসলিমের চারিত্রিক গুণাবলি।
‘মানুষের অনন্ত জীবন’ গ্রন্থের ফ্ল্যাপে ইসলামি চিন্তাবিদ আকরামুজ্জামান আল মাদানী’র মন্তব্য ‘গ্রন্থে দ্বীনি আমল-আকীদা তথা মুমিনের মরণের পূর্বাপর জীবনের বিভিন্ন অবস্থা এবং করণীয় ও বর্জনীয় অনেক বিষয়ের দালিলিক আলোচনা করা হয়েছে।’ গ্রন্থটির ‘প্রাসঙ্গিক ভাবনা’য় এটি রচনার উদ্দেশ্য উপকারিতা বিষয়ক লেখক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সলের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য ‘আমাদের চিন্তা-চেতনায় স্থায়ী আবাস আখেরাতের সুখ-শান্তির গুরুত্বকে জাগিয়ে দেওয়ার এবং শাণিত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে মূলত এই গ্রন্থ রচনার ক্ষুদ্র প্রয়াস।’
‘প্রত্যেক মুসলিমের যেসব বিষয় জানা ওয়াজিব’ তার সম্পাদিত গ্রন্থ। এই গ্রন্থে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মুহাম্মাদ বিন সুলাইমান আত্তামীমী (রহ.) দ্বীন ইসলামের সহিহ বা পরিশুদ্ধ জ্ঞান সম্বলিত অনেক বিষয়ের সহজ ও সারবান আলোচনা অন্তর্ভূক্ত করেছেন। গ্রন্থের বিষয়-নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। ওয়াজিব বিষয়ের জ্ঞান, দ্বীন ইসলামের মূল ভিত্তি, ‘কালেমা’র শর্ত ও প্রমাণ, ইলমের প্রমাণ, দৃঢ় বিশ্বাসের প্রমাণ, ইখলাস বিনষ্টকারী বিষয়সমূহ, তাওহীদ-এর প্রকারভেদ, র্শিক ও র্শিকের প্রকারভেদ, কুফর ও নিফাক-এর প্রকারভেদ ও তাগুত (বাতিল শক্তি) সম্পর্কে কুরআন-হাদিসের প্রামাণ্য-আলোচনা স্বল্প পরিসরে হলেও গ্রন্থের অনিবার্যতা বাড়িয়ে তুলেছে। গ্রন্থটির ব্যাক-কভারে মূল আলোচ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘তেমনি কী কী কাজের মাধ্যমে একজন মুসলিমের ঈমান ভেঙ্গে যায়? মুসলিম জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়সমূহের সাথে পাঠকদেরকে পরিচয় করিয়ে দেবে গ্রন্থটি।’ সম্পাদক তাঁর ভাষায় ‘প্রসঙ্গ : পূর্বকথা’য় এর অপরিহার্যতাকে এভাবে তোলে ধরেছেন ‘বিশ্ব মুসলিমের এই ঐক্যচেতনা ব্যতিরেকে শয়তানি চক্র ও তার অনুসারীদের তন্ত্রমন্ত্র মতবাদ থেকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব নয়। ঐক্যবদ্ধ ঈমানি শক্তির কাছে শয়তানি ষড়যন্ত্র খুবই দুর্বল। জাগ্রতবিবেকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন খুবই জরুরি।’ সম্পাদকের সম্পাদিত ও অনূদিত অপর গ্রন্থটি ‘আপনার ঈমান কি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য? (সংশয় নিরসন)’। একই লেখকের রচিত গ্রন্থটিতে আল্লাহর একত্ববাদ, জ্বীন ও মানুষের শত্রু, কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞান, বাতিলপন্থীদের দাবী খ-ন, দোয়া, শাফায়াত, কুফর ও র্শিক, তাওহীদ বা একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে মৌলিক ও দালিলিক আলোচনা করা হয়েছে।
বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল বাংলাভাষায় মুসলমান ঔপন্যাসিকদের অন্যতম পুরোধা-পুরুষ আর্জুমন্দ আলী রচিত (১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ) সামাজিক উপন্যাস ‘প্রেম-দর্পণ’ সম্পাদনা করে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘প্রেম-দর্পণ’ উপন্যাস সমকালে কতটা সাহিত্যপদবাচ্য ও মূল্যায়নযোগ্য ছিলো এ বিষয়টি উপন্যাসের প্রারম্ভে আর্জুমন্দ আলীর মন্তব্য থেকেই বোধ করি যথার্থভাবে ফোটে উঠেছে। ‘প্রেম-দর্পণ’ সম্পর্কে ঔপন্যাসিক লিখেছেন ‘এই ইতিবৃত্তে গজপতি বিদ্যা দিগ্গজের ন্যায় হাসির অবতারণা থাকিতে পারে…ভ্রমরের ন্যায় সতী না থাকিতে পারে, চন্দ্রশেখর ও প্রতাপের ন্যায় আদর্শ পুরুষের চিত্রও না থাকিতে পারে এবং সর্বশেষে কল্পনা অঙ্কিত সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ রমণী দুর্গেশনন্দিনী, রেবেকা ও আয়েশার ন্যায় সর্বাঙ্গ সুন্দর চিত্র না থাকিতে পারে, কিন্তু ইহার মধ্যে বোধ হয়, কোনও স্থানের বিশেষ কালের বিশেষ সমাজের যথাযথ চিত্র অঙ্কিত রহিয়াছে (প্রেম-দর্পণ,পৃ. ১৩)।’ সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক ইসমাঈল হোসেন সিরাজী রচিত আলোচিত উপন্যাস ‘রায়নন্দিনী’র মতোই আর্জুমন্দ আলী’র ‘প্রেম-দর্পণ’ ও পরবর্তী সময়ে আবদুল মালিক চৌধুরীর ‘পরদেশী’ উপন্যাসের সাহিত্যমূল্য ও সময়োপযোগিতা স্বতঃপ্রমাণিত হয়েছে। বাংলাসাহিত্যে মুসলমান ঔপন্যাসিক হাতেগোনা যে ক’জন, এঁদের দুঃসাহসিক সাহিত্যযাত্রায় আর্জুমন্দ আলীও শামিল হয়েছিলেন। তাই লেখক-সম্পাদক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল দু®প্রাপ্য উপন্যাস ‘প্রেম-দর্পণ’ সম্পাদনা সময়ের চাহিদাকেই পূরণ করেছেন। ‘উপন্যাসের প্রসঙ্গ কথা’য় সম্পাদক উল্লেখ করেন‘বাংলা উপন্যাসচর্চায় মুসলমানদের মধ্যে পথিকৃৎ হিশেবে মীর মোশাররফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১২ খ্রিস্টাব্দ) সঙ্গে স্মর্তব্য নাম আর্জুমন্দ আলী। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদশকে তাঁর প্রকাশিত ‘প্রেম-দর্পণ’ মুসলমান রচিত প্রথম সামাজিক উপন্যাস হিশেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।’ গ্রন্থের কভার ফ্ল্যাপে সম্পাদক বলেন ‘প্রেম-দর্পণ’ লেখকের আত্মজৈবনিক প্রেম উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। উপন্যাসের স্থান-কাল-পাত্রের সঙ্গে লেখকের জীবনকে জড়িত করলে যে গল্পটি দাঁড়ায় : সুন্দরহাট (শ্রীহট্ট) জেলার আমিরনগর (ভাদেশ্বর) গ্রামের কাসেম (আর্জুমন্দ) পার্শ্ববর্তী গ্রাম পার্টোরি (নালিউরি)-তে স্কুল পরিদর্শন করতে গিয়ে এক পরমা সুন্দরী হিন্দুকন্যা ক্ষেত্রমণির (রাসমণি) প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েন। প্রথম দর্শনেই প্রেম। ক্ষেত্রমণি ভূপতি সিংহ (রাজবল্লভ দাস)-এর কন্যা। ক্ষেত্রমণির বিধবা মা সরলা দেবী মদ্যপ গজপতির কাছে তার বিবাহ দেন। ক্ষেত্রমণি পরে গোত্রধর্ম ত্যাগ করে প্রেমে অন্ধ হয়ে কাসেমের বাড়িতে চলে আসে। উপন্যাসে কাসেমের সঙ্গে ক্ষেত্রমণির বিবাহ হলেও বাস্তবে আর্জুমন্দ আলী সামাজিক বাধাবিপত্তির কারণে রাসমণিকে গ্রহণ করতে পারেননি।’ আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের মুসলমানি ঢং যে ক’জন প্রথিতযশা ঔপন্যাসিকের হাতে রূপায়িত-পল্লবিত হয় তন্মধ্যে সিলেটের ভাদেশ্বর পূর্বভাগের কৃতিসন্তান আবদুল মালিক চৌধুরী’র (১৮৯১-১৯৬৭ খ্রি.) নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত আবদুল মালিক চৌধুরীর ‘পরদেশী’ ঔপন্যাসটি সম্পাদনা করে মুসলিম সমাজচেতনা, উপলব্ধি ও স্বার্থবন্দি প্রেমের মানবিক সর্বশেষে আদর্শিক বাঁকগ্রহণের উপাখ্যান পাঠক সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন। সম্পাদক উপন্যাস গ্রন্থের ফ্ল্যাপে উল্লেখ করেন ‘পরদেশী’ উপন্যাসে লেখক খাসিয়া জীবনের এক আলেখ্য অঙ্কন করার চেষ্টা করেছেন। খাসিয়াদের সামাজিক অবস্থান, রীতিনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, নারীর অবস্থান, সংস্কার-কুসংস্কার প্রভৃতি বিবৃত হয়েছি উপন্যাসের সর্বত্র।’ সাম্প্রতিক সময়ে তার কয়েকটি গ্রন্থের পাঠপ্রতিক্রিয়া এখানে ব্যক্ত করছি।
মনের মুকুরে দাগ কাটা মুখ
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার অন্যতম মৌলিকগ্রন্থ মনের মুকুরে দাগ কাটা মুখ। এটি তার অনবদ্য সৃষ্টি। ঊনত্রিশজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছেন খ্যাতিমান স্কলার, সমাজচিন্তক, কবি ও সাহিত্যিকসহ বিশিষ্টজনেরা। বিভিন্ন সময়ে লেখা তার এ মূল্যায়নধর্মী আলোচনাগুলো প্রত্যেক ব্যক্তির স্মারক হিসেবে কাজ করছে। সময় ও তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ রাখার এক অসাধারণ প্রয়াস এটি। বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল সাহিত্যে সুদূরের অভিযাত্রী। মননে তারুণ্য তার সৃষ্টিশীলতাকে শাণিত করেছে। মৌলিক সৃষ্টিকর্মের পাশাপাশি তার সাহিত্য ভা-ারে রয়েছে খাঁটি গদ্যের সমাহার। অগ্রসর চিন্তা ও আদর্শিক চেতনায় এগুলোর বিরল ঔজ্জ্বল্যে স্বতন্ত্র। সরলসভ্য জীবন ও বাগ্মী-স্নিগ্ধতা তাকে সালংকার চরিত্রবৈশিষ্ট্যে শোভিত করেছে। মজলিসী সাহিত্যের বাইরেও তিনি সৃজন নিবিষ্ট প্রচেষ্টায় প্রশংসনীয়। সত্যনিষ্ঠা ও স্পষ্টবাদী গুণাবলির কারণে সুধীসমাজে গ্রহণযোগ্য অবস্থান করে নিয়েছেন। এছাড়া দেড় দশকের প্রকাশনা শিল্পে শুধু গ্রন্থপ্রকাশ নয়, তিনি গ্রন্থ নির্মাণের সাফল্য অর্জন করেছেন। সম্পাদনা, সাহিত্য ও প্রকাশনা জগতে তার সৃজনের দাগ এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মনের মুকুরে দাগ কাটা মুখ গ্রন্থে যারা আলোচিত হয়েছেন তারা লেখককে মুগ্ধ-প্রাণিত করেছেন অথবা তিনি নিজের দায়বোধ থেকে লিখতে তাগিদ অনুভব করেছেন। আলোচিত প্রত্যেকেই নিজস্ব আলোয় উদ্ভাসিত। লেখক শুধু প্রদীপের গুণগান করেছেন। আলোর স্তর বিন্যাস করেছেন নিপুণভাবে। প্রজ¦লিত দীপাবলির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আঁধার ঘুচানোর পৃথিবী সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। মানুষের কৃতিত্ব স্বীকার করার মহৎ চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার লেখায়। তিনি মূলত আলো সংগ্রহ করে আঁধারঘন পথ চলতে চান। মহিমা প্রচারের পৃথিবীতে এবার আলোয় অবগাহন হোক। মনের মুকুরে চিরল-কোমল আলোকরেখা ফুটে উঠুক এই শুভ কামনা।
বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের গৌরবগাথা
বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের গৌরবগাথা একটি গবেষণাধমী গ্রন্থ। সিলেটের সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক পুরো বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসের বর্ণনা করেছেন। কারণ সিলেটি নাগরীলিপি ছাড়া অন্যরা তো বাংলাসাহিত্যেরই কাজ করেছেন। চযার্পদের কবিদের অনেকেই ছিলেন সিলেটি। একই সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলির মূল সত্তা চৈতন্যদেব এবং বিজ্ঞানকাব্যের সাম্প্রতিক ব্যক্তি কবি হাসনাইন সাজ্জাদীও সিলেটের সন্তান। আলোচ্য গ্রন্থটিতে নানা অধ্যায়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। অধ্যায়গুলো হচ্ছেÑবাংলাসাহিত্যে সিলেট, বাংলাকাব্যের বিবর্তন, মধ্যযুগের বাংলাকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি কাব্য, সিলেটের ফারসি চচার্র মৌলিকত্ব ও লৌকিকত্ব, বাংলাসাহিত্য সাধনায় সিলেটের নারীসমাজ, হাসনাইন সাজ্জাদী : বিজ্ঞান কবিতায় যুগ স্রষ্টা থেকে বিজ্ঞানবাদের দার্শনিক এবং বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের পদছায়া। বাংলাসাহিত্যের জন্ম থেকে শুরু করে বতর্মান যুগের বিজ্ঞান কাব্যচর্চার আন্দোলন পর্যন্ত সিলেটিদের কোথায় এবং কীভাবে ভূমিকা রয়েছে তার সবই জানা যাবে গ্রন্থটি পাঠ করে। এরমধ্যে দিয়ে বাংলা সাহিত্যকেই জানা হয়ে যাবে এমনভাবে লেখা হয়েছে গ্রন্থটি।
অধ্যাপক সাদাত উল্লাহ খান যেমন তার ভূমিকায় লিখেছেন, সিলেট বাংলাসাহিত্যের উর্বরভূমি। চযার্পদ থেকে শুরু করে মঙ্গলকাব্যে সিলেটের জয়জয়কার ছিল। বতর্মানে যে, পুঁজিবাদের বিপরীতে বিজ্ঞানবাদ নামে একটি রাজনৈতিক দর্শনের কথা শোনা যাচ্ছে তাও সিলেটের সন্তান বিজ্ঞান কবি হাসনাইন সাজ্জাদীর উপস্থাপিত। একই সঙ্গে বাংলা কাব্যের বাঁক পরিবর্তনে বিজ্ঞান কবিতা একটি আলোচিত বিষয়। কবিতায় উপমা, উৎপ্রেক্ষাও চিত্রকল্পে বিজ্ঞানের প্রয়োগ কবিতার বৈশিষ্ট্য।
লেখকের ভাষ্যমতে, সিলেট, শিলচর ও আসামের পাহাড়ে বসে বৌদ্ধ সহজিয়ারা চর্যাপদ রচনা করেন। সিলেটের মাটি ও মানুষের কথা বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষক মুহাম্মদ আসাদ্দর আলী চর্যাপদে সিলেটি ভাষাগ্রন্থে বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছেন। সিলেটিদের নিজস্ব বর্ণমালা সিলেটি নাগরী লিপির কথাও উল্লেখ আছে আলোচ্য গ্রন্থটিতে। গুরুত্বসহকারে আলোচিত হয়েছে হাসনাইন সাজ্জাদীর বিজ্ঞানবাদ বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্ব ও সাবলীল ছন্দ বিষয়ে। লোকসংস্কৃতি লোকসাহিত্য, ইসলামী দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এবং মরমী সাধক হাসন রাজার মূল্যায়ন গ্রন্থটিকে অনন্য সাধারণের মর্যাদা দেবে। আমি গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি। বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের গৌরবগাথা। বইটি প্রকাশ করেছে পা-ুলিপি প্রকাশন।
সফলতার থ্রি ডাইমেনশন
গ্রন্থে লেখক উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন ইংরেজিতে একটা কথা আছে-‘বেটার লেট দেন নেভার’। অর্থাৎ দেরীতে হলেও শিখা ভালো। লেখক তাঁর বাস্তব জীবন অভিজ্ঞতার আলোকে ‘সফলতার থ্রি ডাইমেনশন’ গ্রন্থটি রচনা করেছেন। যেখানে লেখক প্রতিটি প্রবন্ধে ভূমিকা থেকে উপসংহার পর্যন্ত ধাপে ধাপে বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন। যা পাঠককে সঠিক জীবনের দিক নির্দেশনায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে এবং ডুয়েট জীবনের সফলতার উচ্চ শিখরে আরহনের পথ দেখাবে বলে বিশ্বাস করি। গ্রন্থটির প্রতিটি প্রবন্ধে ভাব ও ভাষায় রয়েছে আগাম ভাবনা। তাঁর গ্রন্থ ‘সফলতার থ্রি ডাইমেনশন’ পাঠ করে আমার তাই মনে হয়েছে। পূর্বে তাঁর বহু লেখা পাঠে মুগ্ধ হয়েছি। তিনি প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে ইতোমধ্যে দেশ ও বিদেশে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। পুনরায় তাঁর ‘সফলতার থ্রি ডাইমেনশন’ গ্রন্থ পাঠ করে মনে হয়েছে তিনি লেখক হবার পথকে আরো সহজ ও সংক্ষিপ্ত করে নিয়ে এসেছেন। তাঁকে তাই অভিবাদন জানাতেই হয়। অভিনন্দন জানাই লেখককে।
শিলচর ভ্রমণের আনন্দস্মৃতি
লোকসাহিত্য গবেষক চৌধুরী হারূন আকবরের নেতৃত্বে একুশতম শিলচর বইমেলায় প্রতিনিধিত্ব করেন মইনুল হক চৌধুরী, আবিদ ফায়সাল ও বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল। বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল তাদের এ ভ্রমণকথা তুলে ধরেছেন তার ‘শিলচর ভ্রমণের আনন্দস্মৃতি’ গ্রন্থে। ভ্রমণ শেষে অনেকটা তাৎক্ষণিকভাবেই যেন বইটি লিখেছেন লেখক। সাহিত্যে ভ্রমণের কাহিনিগুলো সবসময়ই সুখপাঠ্য ও আকর্ষণীয় হয়। এসব কাহিনি পাঠকের মনোসংযোগ সহজেই ধরে রাখতে সক্ষম হয়। বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল এখানে সার্থক নন, এ-কথা বলা যাবে না। শুরু, বিচরণ, সমাপ্তিসহ বর্ণনাশৈলী, উপস্থাপনের চমক, যথাস্থানে ছবি সংযোজন, ছোট ছোট শিরোনামে বিভক্ত করা অংশে পাঁচ দিনের ব্যস্ত ভ্রমণকথাগুলো চমৎকার। নির্মল আনন্দলাভের ক্ষেত্রে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি যতœবান থাকতে কার্পণ্য করেননি এই তরুণ লেখক। প্রথিতযশা গবেষক নন্দলাল শর্মা তার স্বভাবসুলভ মনন চিন্তন দিয়ে এমনভাবে প্রসঙ্গ কথা লিখেছেন যা গ্রন্থপাঠকেরা শুরুতেই গ্রন্থের একটি মৌলিক ধারণা পেয়ে যাবেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের রেশ ধরে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের শিলচরে ১১ জন ভাষাসৈনিকের আত্মাহুতির স্মরণে শিলচরে আয়োজিত হয়ে আসছে প্রতিবছর বইমেলা আর এবারের (২০১৮ খ্রিস্টাব্দ) এই মেলা একুশতম। লেখক ‘আসামে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি’ শীর্ষক লেখার মাধ্যমে শুরু করেছেন। লিখেছেন সিলেট অঞ্চলের সাথে শিলচর অঞ্চলের সাংস্কৃতিক সম্পর্কের কথা, ১১ শহিদ স্মরণে বইমেলার কথা, ইন্দো-বাংলা মৈত্রী ইত্যাদি। এর পরই তাদের যাওয়ার পথের বিবরণ, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের বিবরণ, বিভিন্ন আড্ডা ও মতবিনিময়ের বিবরণ, দর্শনীয় স্থান-স্থাপনার বিবরণ এবং সবশেষে ফেরার বিবরণ। এই সাথে রয়েছে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা ও ভাব বিনিময়ের হৃদয়স্পর্শী আলোকপাত। সবমিলিয়ে ‘শিলচর ভ্রমণের আনন্দস্মৃতি’ গ্রন্থটি চমৎকার। ইয়াহ্ইয়া ফজলের প্রচ্ছদ ভালো। পা-ুলিপি প্রকাশনের মুদ্রণ ভালো। গ্রন্থের মূল্য রাখা রয়েছে আশি টাকা। জুনেদ আহমদ চৌধুরী, ইনাম আহমদ চৌধুরী, ইকবাল আহমদ চৌধুরী, ইন্দোবাংলা-মৈত্রীর তিন শুভাকাক্সক্ষীকে উৎসর্গ করা হয়েছে গ্রন্থটি। তিন ফর্মার এই গ্রন্থটির বাঁধাই, কাগজ, ছাপাকে ভালোই বলা যায়। বায়েজীদ ভ্রমণকাহিনির ধারাবাহিকতাকে যেভাবে সাজিয়ে পাঠকের চোখে তুলে ধরেছেন তাতে তিনি সফল হয়েছেন। কেউ কেউ বলে থাকেন ভ্রমণবৃত্তান্ত সম্পর্কীয় লেখা বড় বড় লেখকদের পড়লে ভালো লাগে, নতুন লেখকদের ভ্রমণ-লেখা তেমন ভালো হয় না। আসলে লেখক দেখে লেখাকে ভালো-খারাপ নির্দেশন সঠিক বা গ্রহণযোগ্য নয়। লেখাই এখানে আসল। লেখক নয় লেখা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বায়েজীদ তার গ্রন্থ ‘শিলচর ভ্রমণের আনন্দস্মৃতি’ স্বল্প পরিসরের হলেও সামগ্রিক ক্ষেত্রে সার্থকতা পাবে একথা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়। প্রফেসর নন্দলাল শর্মা যথার্থই বলেছেন বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল সংক্ষেপে গ্রন্থটি রচনা করলেও তার বর্ণনা সরস ও উপভোগ্য। মধ্যে মধ্যে ইতিহাসের কথাও এসেছে। এসেছে শিলচরের ভাষা সংগ্রাম, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পটভূমি এবং প-িত মুহাম্মদ আব্দুল বারীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। লেখকের সঙ্গে পাঠকও শিলচরের দর্শনীয় স্থান ও বইমেলা মানসলোকে দেখতে পাবেন। লেখকের ভাষা প্রাঞ্জল, বর্ণনারীতি সরস। আশা করি বইটি সুধীমহলে আদরণীয় হবে।
বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল বিভিন্ন সামাজিক-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি পা-ুলিপি প্রকাশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, গোলাপগঞ্জ ফাউন্ডেশনের সভাপতি, হলিসিটি ট্যুরিস্ট ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ ও মোবাইল পাঠাগারের জীবনসদস্য। পরিশ্রম ও মেধার সমন্বিত সাফল্যে রোটার্যাক্ট ক্লাব অব সিলেট হলিল্যান্ড তাকে প্রদান করেছে সম্মাননা পদক (২০০৯-১০ খ্রি.)। তার নানামাত্রিক সৃজনশীলতা হোক আরো বেগবান ক্রমশ কল্যাণমুখর এ প্রত্যাশা। বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল সাহিত্যের বিবিধ সৃষ্টি-সেবায় সময়ের আলোকিত তরুণ। ঝিমিয়ে পড়া তারুণ্যের বেলাভূমিতে তাঁর মতো তরুণের কর্মমুখরতা আমাদের উদ্দীপ্ত করে। সিলেটসাহিত্যে চলমান সৃষ্টিধারাকে অব্যাহত রাখতে তাঁর অবিরাম পথচলা এ অঙ্গনকে ঋদ্ধ করবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক