হাকালুকি হাওরাঞ্চলে খাল-বিল ভরাট : হুমকিতে জীববৈচিত্র্য
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:৩৮ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ:
পানিনিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থার না থাকায় হাকালুকি হাওরের দুই শতাধিক বিলের পানির স্বাভাবিক স্রোত বিনষ্ট হচ্ছে। এতে পানি আশপাশের জমিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এক পর্যায়ে সেই পানি শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে হাওরের বিশাল অংশের তলদেশে পলি জমে খাল-বিল ভরাট হচ্ছে ক্রমশ। এ অবস্থা চলছে বিগত কয়েক বছর ধরে। এতে হাকালুকি হাওর হারাচ্ছে তার চিরচরিত জীববৈচিত্র্য। পরিবেশবাদীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে হাকালুকির ভবিষ্যৎ সঙ্কটে পড়বে। এখানে মানুষের জীবন ব্যবস্থার ওপর পড়বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বাড়বে আশপাশে অকালে বন্যার প্রভাব। পানির স্বাভাবিক স্রোত না থাকায় এবং পলি জমে বিল ভরাটের কারণে এখানে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে এখানে মাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
সরকারি তথ্যমতে, প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর আয়তনের হাকালুকি বর্ষাকালে হাওর সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে বিশাল রূপ ধারণ করে। এই সময় পানির গভীরতা হয় ২-৬ মিটার। ২৪ হাজার ৭শ হেক্টরে। হাওরের ৮০ ভাগ মৌলভীবাজারে ও ২০ ভাগ সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। মৌলভীবাজারের বড়লেখা অংশে ৬০ ভাগ কুলাউড়ায় ১২ ও জুড়ি উপজেলায় ৮ ভাগ রয়েছে। হাওরে ছোট বড় ২৩৮টি বিল রয়েছে। এর মধ্যে মৌলভীবাজার অংশে ২০০টি আর বাকি ৩৮টি সিলেট অংশে। বর্তমানে অস্তিত্ব রয়েছে ২১৭টি বিলের। তার মধ্যে বড়লেখায় ১২০টি, কুলাউড়া ৪৫টি, জুড়ি ১৫টি, ফেঞ্চুগঞ্জ ২২টি, গোলাপগঞ্জ ১৫টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ চাতলা বিল, চকিয়া বিল, ডুলা বিল, পিংলারকোণা বিল, ফুটি বিল, তুরল বিল, তেকুনি বিল, পাওল বিল, জুয়ালা বিল, কাইয়ারকোণা বিল, বালিজুড়ি বিল, কুকুরডুবি বিল, কাটুয়া বিল, বিরাই বিল, রাহিয়া বিল, চিনাউরা বিল, দুধাল বিল, মায়াজুরি বিল, বারজালা বিল, পারজালাবিল, মুছনা বিল, লাম্বা বিল, দিয়া বিল, তুরল বিল, গড়কুড়ি বিল, রঞ্চি বিল, বড় বিলের মধ্যে অন্য পলভাঙা, জুড়ি বিল, মালাম বিল।
জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, এসব বিলের মধ্যে সম্পূর্ণ ভরাট হয়েছে কমপক্ষে ২১টি বিল। এ ছাড়া বাকিগুলোর অধিকাংশহ আংশিক ভরাট হয়েছে। সম্পূর্ণ ভরাট হওয়া বিলের মধ্যে কুলাউড়া উপজেলার মেদি বিল, ধলিয়া হাওর বিল, চিকনমাটি বিল, আদা চাপড়া বিল, বিলাইয়া বিল, বইশমারা বিল। আর কোনোভাবে অস্তিস্ব টিকে আছে, হিংলি বিল, ফুটি বিল, ডুলা বিল, পিংলারকোণা, তেকুনি বিল, পাওল বিল, চিনাউরা বিল, দুধাল বিল, বারজালা বিল, পারজালাবিল, মুছনা বিল, লাম্বা বিল। সমাপূর্ণ ভরাট হয়েছে জুড়ি উপজেলার তুরল বিল, হুগলা বিল, লামা তুরল, ওপর তুরল, লাড়ির ডাক, বালিয়াজুড়ি। আর বড়লেখা উপজেলার মালাম বিল, ফুয়ালা বিল, জল্লা বিল, বালিয়া বিল, মাইজলা বিল, হাওর খাল অন্যতম।
সরেজমিন হাকালুকিতে গিয়ে দেখা যায়, বিলাইয়া বিল, বইশমারা বিলের বুকে মহিষ চড়াচ্ছেন স্থানীয়রা। প্রায় শুকনো বুকের এসব বিলে কিছু কিছু অংশে অল্প পরিমাণ পানি রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, এসব বিলে এক সময় প্রচুর পানি থাকত। মাছ ধরা পড়ত। পাখিরা আসত কিন্তু ক্রমশ ভরাট হয়ে এখন শুকনো মাঠের আকার ধারণ করেছে। হাকালুকি এলাকার মৎস্য ব্যবসায়ী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বর্ষায় এসব বিল এলাকায় ভাসান পানি থাকে। অধিকাংশ ছোট বিলগুলোতে অতীতের মতো হচ্ছে মৎস্য চাষ। এগুলোতে শুকনো মৌসুমে এখন প্রায় ৮ থেকে ১০ ফুট পলি মাটি। স্থানীয়রা গরু-মহিষ চড়াচ্ছে। বিলের অনেক জায়গা দখল করে অনেকে ফসল ফলাচ্ছে।
এদিকে সরকারি এবং স্থানীয় তথ্যমতে হাকালুকির সঙ্গে যুক্ত ছিল প্রায় ১০টি ছোট বড় নদী। এর মধ্যে জুড়ি নদী, কণ্ঠিনালা, মরা জুড়ি, ফানাই নদী, নিকড়ি, ষাটমা নদী, বরুদল, বিলাম নদী এবং সুনাই নদী এর মধ্যে বর্তমানে টিকে আছে মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলায় জুড়ি নদী ও কণ্ঠিনালা। কুলাউড়ায় ফানাই নদী আর বড়লেখার সুনাই নদী। বাকিগুলো পরিণত হয়েছে ছোট খালে। নদীর এই জলরাশি হাওরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিবছর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রচুর পলি আসে হাওরে, যা বিলগুলো ভরাট করে দেয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতর এবং সেন্টার ফর ন্যাচারাল স্টাডিজ (সিএনআরএস) ২০০৩-২০১৮ সাল পর্যন্ত হাকালুকিতে যৌথভাবে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। সেই প্রকল্পের তথ্যমতে, প্রকল্পের আওতাধীন হাওরের ছিল ছোট বড় ৩ শতাধিক ছড়া ও খাল। যা বর্তমানে প্রবাহ চলমান ছড়া আছে প্রায় ৮১টি। বাকিগুলো বিলীন হয়েছে। বিলীন হওয়া ছড়া খালের মধ্যে সারর খাল, চান্দর খাল, গোগালী ছড়া, কচমার খাল, লামাই লঙ্গির খাল, জামলার খাল,কাটুয়া খাল, পনার খাল উল্লেখযোগ্য।
সাদিপুর গ্রামের মৎস্যজীবী বদল মিয়া জানান, হাওর খাল ভরাট হওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন মৎস্যজীবীরা। বর্ষায় ভাসান পানিতে আগের মতো আর মাছ জন্মায় না। শুষ্ক মৌসুমে বিলগুলো শুকিয়ে মাছ ধরার কারণে অবশিষ্ট মা মাছ আর না থাকায় দিনদিন মাছ কমছে। বিপদে পড়েছেন হাওর পাড়ের জেলেরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার মৌলভীবাজারের সভাপতি আস স ম সালেহ সোহেল জানান, হাকালুকি হাওরকে মিঠাপানির অন্যতম প্রজননকেন্দ্র বলা হয়। বাংলাদেশে জলজ উদ্ভিদ প্রজাতির অর্ধেকেরও বেশি হাকালুকি হাওরে জন্মে। হাওর তীরের প্রায় দুই লাখ মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই হাওরের ওপর নির্ভরশীল। হাকালুকি হাওরে ১৫০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছের মধ্যে বর্তমানে ১১২ প্রজাতি টিকে আছে। ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ১২০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ও সরিসৃপ এখন বিলুপ্ত প্রায়। এখানে প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২০০ বিরল প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসত। এখন আর আসে না। বিল খাল নদী ভরাটের ফলে জীববৈচিত্র্য টিকতে না পারায় হারিয়ে যাচ্ছে। এদের রক্ষায় এখনই ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, জেলায় মাছের চাহিদা ৪৩ হাজার টন। এর মধ্যে প্রতি বছর ১৪ হাজার টন মাছ উৎপাদন হয় হাকালুকিতে। বিল ভরাটের কারণে মাছের উৎপাদন কমে কিন্তু বিল নার্সারি স্থাপনসহ মৎস্য বিভাগের নানা উদ্যোগের কারণে সেই উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া মাছের ১৫টি অভয়াশ্রম আছে হাকালুকিতে।