চোরাপথে ‘অমর’ হতে চান সিলেটের রাগীব আলী
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ জানুয়ারি ২০২০, ৬:৪৮ অপরাহ্ণ
সাঈদ চৌধুরী টিপু:
জালালাবাদ সিলেটেরই একটি পরিচিতিমূলক নাম। সিলেটবিজয়ী সাধকপুরুষ হযরত শাহজালালের স্মৃতিকে ধরে রেখেছে নামটি। এ নামের সাথে দুজন ব্যক্তির নামজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি ফাউন্ডেশন- ‘জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন’। প্রথম নামটি সিলেটের বিতর্কিত শিল্পপতি রাগীব আলীর। আর শেষের নামটি তার স্ত্রী প্রয়াত রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর। নিজেকে আর স্ত্রীকে জালালাবাদে ‘অমর’ করে তোলার লক্ষ্যেই ফাউন্ডেশনটির জন্ম। কর্মের মধ্য দিয়ে অমর হওয়ার স্বপ্ন অনেকেরই থাকে। তবে রাগীব আলী অমর হতে চেয়েছেন চোরাপথে। তিনি বেছে নিয়েছেন শর্টকাট পথ, যে পথে কেবলই ফাঁকিঝুকির আঁকিবুকি।
ইংরেজি শব্দ ফাউন্ডেশনের অর্থ হচ্ছে সেবা বা এরকম কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত সংগঠন। আবার এ ফাউন্ডেশনেরই আরেকটি অর্থ ভিত্তি। ভিত্তি না থাকলে কোনো কিছুই গড়ে উঠা সম্ভব নয়-ফাউন্ডেশন তো নয়ই। সাদা চোখে এমনটি মনে হলেও সিলেটের জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশনের ক্ষেত্রে তা ভুল প্রমাণ করেছেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা রাগীব আলী, যিনি নিজেকে দানবীর হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অলাভজনক, অরাজনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক সংস্থার পরিচয়ে গড়ে উঠা ফাউন্ডেশনটির আদতে কোনো ভিত্তিই নেই। জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশনের অধীনে একাধিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি মেডিকেল কলেজও পরিচালিত হচ্ছে। ‘সৃষ্টির কল্যাণ, দেশ ও সমাজের উন্নয়ন’ এমন আপ্তবাক্য উচ্চারণের প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ‘দানবীর’ রাগীব আলীর রয়েছে হরিলুটের বড় গল্প। এর অধীনে ২০০১ সালে চালু হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘লিডিং ইউনিভার্সিটি’। আর তারও আগে ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ‘রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল’কে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে নিয়ে আসা হয় এর অধীনে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানই হয়ে উঠে রাগীব আলী’র সম্পদ অর্জনের অন্যতম উৎস। এ দুটো প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে টাকা জমা হয়েছে রাগীব আলীর নিজস্ব তহবিলে। আর এর পেছনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে রাগীব আলীর নিয়ন্ত্রণাধীন বেসরকারি ব্যাংক সাউথ ইস্ট।
এক তারাপুর চা বাগান দিয়েই নিজের পকেট ভালোই ভারি করে নিয়েছিলেন রাগীব আলী। বাগানটি ছিলো তার জন্য ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁসে’র মতোই। তবে জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ায় সে ‘সোনাফলা’ তারাপুরের কর্তৃত্ব হারান রাগীব আলী। জেলও খাটেন। এখন তার পুঁজি কেবল জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন। রাগীব আলী তাই যক্ষের ধনের মতো ফাউন্ডেশনটি আঁকড়ে রেখেছেন।
জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশনের জন্ম ১৯৯৮ সালে। ওই বছরের ৬ মে সিলেট সাব রেজিস্ট্রি অফিসে ট্রাস্ট ডিডের মাধ্যমে (দলিল নং: ইড়ড়শ ওঠ-৩১) জন্ম হয় প্রতিষ্ঠানটির। প্রতিষ্ঠার সময় ফাউন্ডেশনের সদস্য হিসেবে ছিলেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুর রহিম, অ্যাডভোকেট একেএম হামিদ বক্ত চৌধুরী, মেজর জেনারেল নাজমুল ইসলামসহ আরও অনেকেই। ১১ বছরের মাথায় ফাউন্ডেশনকে পুরোপুরি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে আনেন রাগীব আলী। একটি সংশোধনীর মাধ্যমে ফাউন্ডেশনের খোল-নলচে পাল্টে দেন। সিলেটের চেনা মুখগুলোর পরিবর্তে যুক্ত হন তার পরিবারের সদস্যরা। ছেলে আবদুল হাই, আবদুল হাইয়ের প্রথম স্ত্রী লুৎফুন্নাহার হাই ও ছেলে রাফে হাই, মেয়ে রেজিনা কাদের, জামাতা আবদুল কাদের ও ভাতিজা আব্দুল হান্নান। পরবর্তীতে লুৎফুন্নাহার হাইয়ের সাথে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটলে তার পরিবর্তে যুক্ত হন ছেলে আবদুল হাইয়ের নতুন স্ত্রী ভারতীয় নাগরিক ও পাসপোর্টধারী সাদেকা জান্নাত। তবে তারাপুর চা বাগান জালিয়াতির ঘটনায় জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে আসার পর রাগীব আলী চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতাবলে ফাউন্ডেশনে আরেক দফা কাটাকুটি খেলেন। নিজের একক নিয়ন্ত্রণে রাখতে নতুন করে সাজান ফাউন্ডেশন। এবার ছাঁটাই হন, মেয়ে রেজিনা কাদির ও তার স্বামী আবদুল কাদির। এখন ফাউন্ডেশনের সবগুলো মুখই রাগীব আলীর পরম আস্থাভাজনদের। ফাউন্ডেশনের বোর্ডসভায় নতুন করে জায়গা পেয়েছেন লিডিং ইউনিভার্সিটির কোষাধ্যক্ষ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব বনমালী ভৌমিক, লিডিং ইউনিভার্সিটির ঠিকাদার ও হোমল্যান্ড এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. আকতারুজ্জামান, রাগিব আলীর দত্তক পুত্র দেওয়ান সাকিব আহমদ ও রাজনগরের জনৈক জাকির হোসেন। এর মধ্যে বনমালী ভৌমিককে দেওয়া হয়েছে ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব। ফাউন্ডেশনে পুরনো মুখ হিসেবে রয়েছেন রাগীব আলীর ছেলে আব্দুল হাই, আবদুল হাইয়ের প্রথম স্ত্রীর ছেলে রাফে হাই এবং রাগীব আলীর ভাতিজা আবদুল হান্নান। এরমধ্যে রাগীব আলীর সবচেয়ে ভরসার নামটি হচ্ছে-বনমালী ভৌমিক। জীবনে সাবেক আমলা বনমালী ভৌমিক রাগীব আলীর জেলখাটা পরবর্তী জীবনে তার ডান হাত হয়ে উঠেছেন। তিনি এতোটাই আস্থা অর্জন করেছেন যে লিডিং ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার থাকাবস্থাতেই রাগীব আলী তাকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে কিছুদিন তার মালিকানাধীন পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বও দিয়েছিলেন।
জালিয়াতি রয়েছে জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও। প্রতিষ্ঠানটির গঠনতন্ত্র সিলেট সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে ১৯৯৮ সালের ৬ মে নিবন্ধনকৃত ও পরবর্তীতে ২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর সংশোধনকৃত থাকলেও রাগীব রাবেয়া ফাউন্ডেশনটি আজো সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর তথা দি সোসাইটিজ রেজিষ্ট্রেশন এ্যাক্ট ১৮৬০ অনুসারে রেজিষ্ট্রেশন হয়নি বা কোম্পানী আইনেও জয়েন্ট স্টক রেজিষ্টারের দপ্তরেও রেজিষ্ট্রি হয়নি, এমনকি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাজসেবা অধিদপ্তরেরও তালিকাভুক্ত হয়নি।
রাগীব আলীর জাল জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ার পূর্ব পর্যন্ত সিলেট নগরীর লালদিঘীরপারস্থ সাউথ ইস্ট ব্যাংকে রাগীব রাবেয়া ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাবে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সব আয় জমা হতো। নিজের পকেট ভরার পাশাপাশি রাগীব আলী এ তহবিল থেকেই টাকা বিলিয়ে ‘দানবীর’ পরিচয়কেও সমৃদ্ধ করেছেন। উচ্চ আদালতের রায়ের পর সাউথ ইস্ট ব্যাংকের ওই শাখায় রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশনের হিসাবে কোনো টাকা জমা না হলেও মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে তিনি একটি বিশাল অংক এখনও পেয়ে থাকেন।
ফাউন্ডেশনের অধীনে থাকা জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটি তারাপুরের সীমানার ভেতরে থাকায় এটির আয়ে কিছুটা ঘাটতি হলেও লিডিং ইউনিভার্সিটি ঠিকই তার জন্য টাকার খনি হয়ে রয়েছে। মাসে মাসে টাকা জমা হচ্ছে রাগীব আলীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। বিভিন্ন খাতের নামেও টাকা ঢুকছে। যাচাই বাছাই না করে সাউথ-ইস্ট ব্যাংকও চোখ বুজে তা অনুমোদন করছে।
রাগিব রাবেয়া ফাউন্ডেশনের অধীনে বছরে কোটি কোটি টাকা লেন-দেন হলেও সরকারের কোনো মন্ত্রণালয়ে বা অধিদপ্তরে অনিবন্ধিত, অনুমোদনহীন হওয়ায় কারো কাছেই ফাউন্ডেশনের জবাবদিহিতা নেই। তাই চলছে বেপরোয়া লুটপাট। সূত্র- একাত্তরের কথা।