এখনো ভাতা থেকে বঞ্চিত কুলাউড়ার মুক্তিযোদ্ধা সীতারাম ভর
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ আগস্ট ২০১৭, ৫:৪৫ অপরাহ্ণ
এস এইচ সৈকত, মৌলভীবাজার থেকে:
এখনো ভাতা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার সেই মুক্তিযোদ্ধা সীতারাম ভর ওরফে গংগারাম ভর। দেশ মাতৃকার টানে ১৯৭১ সালে দেশের জন্য যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। উপজেলার সীমান্তবর্তী শরীফপুরের চাতলাপুর বাগানের পালকিছড়ার বাসিন্দা এই বীরযোদ্ধা ভাতা না পেয়ে বিনাচিকিৎসায় পাগলের মতো ঘুরছেন এখান থেকে সেখানে।
কখনো ভিক্ষে করে খাচ্ছেন, আবার কখনো না খেয়ে থাকেন। গৃহহীন এই বীরযোদ্ধা বর্তমানে চাতলাপুর হাসপাতালের কোন এক কোনে রাত্রি যাপন করেন। কিন্তু তাঁরই ভাতিজা স্ত্রী রাম পিয়ারী ভর সীতারাম ভরকে তার মৃত স্বামী দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আত্মসাৎ করছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলেও এখনো বিষয়টি সংশোধন করা হয় নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের ডানকান ব্রাদার্সের মালিকানাধীন চাতলাপুর চা বাগানের পালকিছড়া ভর টিলায় জন্ম গ্রহণ করেন সীতারাম ভর। যুবক বয়সে সীতারাম দেশের টানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তিনি হয়ে যান কিছুটা মানসিক বিকারগ্রস্থ। নিজস্ব কোন বাসস্থান না থাকায় তিনি চাতলাপুর চা বাগানের মন্দিরের পাশে একটি পরিত্যক্ত চায়ের দোকানে দীর্ঘদিন থাকার পর বর্তমানে তিনি ওই হাসপাতালের কোন এক কোনে পড়ে থাকেন।
সীতারামের মামাত ভাই যোদ্ধাহত পঞ্চম ভর, ওই এলাকার শ্রীবানন ভর ও নারায়ণ গোয়ালাসহ অনেকেই জানান, সীতারামের আপন ভাতিজা বাবুয়া ভরের স্ত্রী রাম পিয়ারী ভর তাকে (সীতারামকে) মৃত স্বামী দেখিয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তফজ্জুল হোসেন চিনু ও সাবেক ইউপি সদস্য রাধা কুর্মির সহযোগিতায় দির্ঘদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আত্মসাৎ করে আসছেন। অথচ সীতারাম পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় খেয়ে না খেয়ে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছেন। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেও এদেশে বেঁচে থেকেও মৃত হয়ে আছেন। যারা জীবিত লোককে মৃত দেখিয়ে ভাতা আত্মসাৎ করছেন তাদের সকলকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত।
পঞ্চম ভর আরও বলেন, কুলাউড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের কাছে গেলে তিনি বলেন মুক্তিযোদ্ধা ভাতাটি ভাগ-ভাটোয়ারা করে খেতে। যেখানে তাকে মৃত দেখানো হয়েছে তাকে আবার জীবিত দেখানো সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, সীতারাম ভর বিয়ে করেন জেরিন চা বাগানের চা শ্রমিক কন্যা সাবিত্রী রানী ভরকে। শ্রীভর (১৭) ও সোনিয়া ভর (১৪) নামে তাঁর দু’টি সন্তান রয়েছে। সাবিত্রী ও তার সন্তানেরা জেরিন চা বাগানে থাকেন। গত ১৪ মার্চ কে বা কারা সীতারামকে মেরে ডবলছড়া পাহাড়ে ফেলে যায়। আমরা অনেক খোঁজাখোজির পর তাকে ওই পাহাড় থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই। তিনি তাঁর ভাইয়ের প্রকৃত স্বীকৃতি, তাঁর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা দাবি করেন।
মুক্তিযোদ্ধা সীতারাম ভর বলেন, “যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেও ঘর-বাড়ি ছাড়া এখন রাস্তায় রাস্তায় খেয়ে না খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। স্বাধীন দেশে প্রতারণার স্বীকার হয়ে সরকারী ভাতা থেকেও বঞ্চিত হয়েছি।”
কুলাউড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কল্লোল শাহ বলেন, “ব্যাপারটি অনেক আগের তাই আমার জানা ছিলোনা। বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলা সমাজকল্যাণ ও মুক্তিযোদ্ধবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও স্থানীয় ইউপি মেম্বারকে বইটি জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছি। শীঘ্রই বিষয়টি তদন্ত করে এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ইউএনও স্যারের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।”
কুলাউড়া মুক্তিযোদ্ধা কামান্ডার সুশীল চন্দ্র দে বলেন, আমার সাথে কেউ এবিসয়ে অভিযোগ দেয় নি কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রচার হলে আমি কৌশলে বইটি জব্দ করেছি। সীতারাম ভরের মানষিক অবস্থা ভাল না থাকায় আমি নিজের পকেটের টাকায় তার চিকিৎসা করাচ্ছি। এছাড়াও তাকে আমি মাঝে মধ্যে আর্থিক ভাবে সহায়তা করে যাচ্ছি। জেলা মুক্তিযোদ্ধা কামান্ডার অসুস্থ থাকায় উনার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। উনি সুস্থ হয়ে উঠলে আমরা আলোচনা করে দেখবো তার নামে বইটি দেয়া যায় কিনা। আমরা চাই তার জীবনদশায় তার টাকাটা সেই পাক।
যেখানে তাকে মৃত দেখানো হয়েছে তাকে আবার জীবিত দেখানো সম্ভব নয় তাই ভাতাটি ভাগ-ভাটোয়ারা করে খেতে বলেছেন কিনা এমন পশ্ন করলে তিনি বলেন, আমার এই কথাটা বলার কোন প্রয়োজনই আসে না। তবে আমি বলেছি, দেখি আমরা কোন ব্যবস্থা করতে পারি কিনা যেভাবে ভাতাটি সীতারাম খেতে পারে। মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করা অনেক কঠিন ব্যাপার। পরে চিন্তা করে দেখলাম এটা সম্পূর্ণ বেআইনি হবে যেহেতু ওই মহিলাটা তার ভাতিজার স্ত্রী।
সীতারাম ভরের স্ত্রী-সন্তান রয়েছে বলে পঞ্চম ভর দাবি করলেও এই কামান্ডার কথাটাকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, তার কোন স্ত্রী-সন্তান নেই তবে একটা বোন আছে।