রমজান, কুরআন, সিয়াম ও তাকওয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ জুন ২০১৭, ৬:১৭ অপরাহ্ণ
মাওলানা মিরাজ রহমান: আরবী চান্দ্রমাসের মধ্যে রমজানকে শ্রেষ্ঠ মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। কেননা, এ মাসে মানবজাতির মুক্তির দিক-নির্দেশনা হিসেবে আল-কুরআনকে অবতীর্ণ করা হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন-রমজান এমন একটি মাস, যে মাসে কুরআনকে অবতীর্ণ করা হয়েছে। অর্থাৎ, মাহে রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য জড়িয়ে আছে পবিত্র কুরআনের সাথে। বিশেষ করে এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যে রাতকে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম রাত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর তাও এজন্য যে এ রাতেই পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
আল্লাহ পাক বলেন- এ রাতেই (লাইলাতুল কদর) আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি। মোটকথা মাহে রমজান ও লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য পবিত্র কুরআনের কারণেই। তাই রমজান মুসলিম উম্মাহর মাঝে আসে এক কল্যাণময় ও তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা নিয়ে। একজন মুমিন তার ঈমান ও আমলকে উন্নত করার লক্ষ্যে এ মাসের জন্য দীর্ঘ ১১টি মাস অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে।
কেননা, কুরআন নাযিলের কারণে এ মাসের ইবাদত-বন্দেগীর ফজিলত অন্যান্য মাসের চাইতে অনেক অনেক গুণ বেশি। ফলে রমজানে সিয়াম সাধনা রোজাদার ব্যক্তির অন্তরে আল্লাহ প্রতি ঐকান্তিক বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে, প্রভু প্রেমে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে রোজাদারদের দেহ-মন।
কুরআন: কুরআন মানব জাতির জন্য আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। এর মাধ্যমে তিনি মানব জাতিকে আইন ও জীবন ব্যবস্থার পথ সুস্পষ্ট রূপে বাতলে দিয়েছেন। কুরআনের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ পাক বলেন- কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য হেদায়েত স্বরূপ এবং পথ নির্দেশনার সুস্পষ্ট দলিল আর হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী।
অর্থাৎ, কুরআন বর্ণ, বংশ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য অনুপম আদর্শ হিসেবে উপস্থাপিত। সামগ্রিক মানবীয় জীবনাদর্শের অনন্য গাইড লাইন হিসেবে কুরআন যে পথ নির্দেশনা প্রদান করে পৃথিবীতে অন্য কোনো গ্রন্থ তা পেশ করতে পারেনি। কুরআনে যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে- “অর্থাৎ, তোমরা যদি কুরআন সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহে পতিত হও তাহলে কুরআনের একটি সুরার ন্যায় অন্য একটি সুরা রচনা করে নিয়ে আস।”
এ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে আরবি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি লবীদ বলতে বাধ্য হয়েছেন, “এটা কোনো মানব রচিত গ্রন্থ নয়।” বাস্তবিকই ঐশী গ্রন্থ হিসেবে কুরআন মানুষকে দিয়েছে সঠিক পথের দিশা। উপরন্তু যুগ পরিক্রমায় সত্যের সাথে অসত্যের বেড়াজালে মানুষ যেন জড়িয়ে না পড়ে সে জন্য কুরআন সত্যকে সত্য হিসেবে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে, যাতে করে মানুষ কুরআনের প্রকৃত মহিমা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। যদিও প্রকৃতপক্ষে কুরআন গোটা মানবজাতির জন্য হেদায়েতের দিক নির্দেশিকা হিসেবে অবতীর্ণ, এতদসত্ত্বেও সকল মানুষ তার থেকে কল্যাণ অর্জন করতে পারে না।
এর কারণ হচ্ছে কুরআন থেকে হেদায়েত পেতে হলে যে গুণটি প্রথম দরকার তা হচ্ছে- তাকওয়া। কুরআনের প্রারম্ভেই বলা হয়েছে, এ কুরআন হচ্ছে মোত্তাকীনের জন্য হেদায়েত স্বরূপ। তাত্ত্বিক অর্থে, আলো সকলকেই অন্ধকারে পথের দিশা দিয়ে থাকে। কিন্তু অন্ধ ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি না থাকার কারণে সে আলো থাকা সত্ত্বেও পথ চলতে পারে না।
এর জন্য দোষটা আলোর নয়, তার দৃষ্টিহীনতার। এমনি কুরআনের হেদায়েত তথ্য আলো পেতে হলে সর্ব কাজে আল্লাহকে ভয় করতে হবে। অন্তরে খোদাভীতি জাগ্রত হলেই কুরআনের প্রভাব আমাদের মাঝে প্রতিফলিত হবে। তাই কুরআনের আলো ধারণ করার জন্য চাই অন্তরে সর্বদা আল্লাহকে ভয় করার জাগ্রত চেতনা। প্রতিটি কাজে-কর্মে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা। রমজান মানুষের মাঝে এ খোদাভীতি অর্জনের প্রেরণা সৃষ্টি করে।
সিয়াম: সিয়াম ইসলামের একটি অন্যতম রুকন। আত্মশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে মহান প্রভু আমাদের উপর সিয়াম সাধনা করা অত্যাবশ্যকীয় করে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে- অর্থাৎ, অতঃপর যে ব্যক্তি এ মাসটি পায় সে যেন সিয়াম সাধনা করে। অন্যত্র বলা হয়েছে- অর্থাৎ, ওহে যারা ঈমান এনেছে!
তোমাদের উপর সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে, যেমনিভাবে দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার। অতএব বলা যায়, সিয়ামের গুরুত্ব ও মর্যাদা কুরআনের জন্য আর কুরআন মানবজাতির একমাত্র গাইড লাইন। এ গাইড লাইন পেতে হলে দরকার তাকওয়ার। আর এ তাকওয়া অর্জনে সিয়াম বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
তাকওয়া: একজন মুমিনের শ্রেষ্ঠ গুণ। তাকওয়া তথা খোদাভীতি অন্তরে না থাকলে মানুষ যে কোনো গর্হিত কাজ করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করে না। তাকওয়ার পরিচয় প্রদান প্রসঙ্গে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা)- এর বর্ণনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য- অর্থাৎ, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) উবাই ইবনে কা’ব (রা)-এর নিকট তাকওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি কি কন্টকাকীর্ণ পথে চলেন?’ তিনি জবাবে বললেন, ‘হ্যাঁ’, উবাই ইবনে কা’ব (রা) বললেন, ‘তখন আপনি কীভাবে চলেন?’ তিনি বললেন, ‘খুব সতর্কতার সাথে কাঁটার আঁচড় থেকে শরীর ও কাপড় বাঁচিয়ে চলি।’ উবাই (রা) বলেন, ‘ইহাই তাকওয়া’।
আমাদের পথ চলার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে রয়েছে দুর্গম বাধা। আজ অসত্যের সামনে সত্য বিলুপ্ত হবার উপক্রম। মানুষ আজ খোদাভীতি নামক মহৎ গুণটি হারিয়ে দুনিয়ার রঙখেলায় মত্ত। রমজান প্রতিবছরই আমাদের মাঝে তাকওয়ার শিক্ষা বয়ে আনলেও তা আমরা মনে-প্রাণে কতটুকু গ্রহণ করতে পারছি সেটা আজ ভেবে দেখা দরকার।
আমাদের অন্তরের উপলব্ধি কি প্রহেলিকায় আচ্ছন্ন? সত্যিকার অর্থে আমরা যদি দীর্ঘ একটি মাস অন্তরের গভীর উচ্ছ্বাস ও পূণ্য প্রাপ্তির প্রত্যাশায় সিয়াম সাধনা করি তাহলে (ইনশাআল্লাহ) তাকওয়া অর্জনে সফলতা লাভ করতে পারব, যার গ্যারান্টি আল্লাহ পাক নিজেই দিয়েছেন। ফলে আমাদের অন্তর কুরআনের আলো ধারণ করার উপযোগী হয়ে উঠবে।