মান্নান-মতিউর মুখোমুখি বিভেদের আগুন জ্বলছে সুনামগঞ্জে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ জানুয়ারি ২০১৭, ৪:১২ পূর্বাহ্ণ
চৌধুরী মুমতাজ আহমদ, সুনামগঞ্জ থেকে ফিরেঃ
একজন সাবেক এমপি। অন্যজন বর্তমান এমপি। প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দুটো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও আছেন। দুজনেই একই দলের অনুসারী। ঠিকানা একই জেলায় হলেও একই সংসদীয় আসনের বাসিন্দা না হওয়ায় তাদের মধ্যে ‘বিভেদ’ হওয়ার কথা নয়। যা হওয়ার কথা নয় তাদের নিয়ে সুনামগঞ্জে, তা-ই হচ্ছে। আওয়ামী রাজনীতির মাঠে আগুন জ্বলছে এ দুই নেতাকে কেন্দ্র করে। সাবেক ও বর্তমান এ দুই এমপি প্রশ্ন তুলেছেন একে অপরের যোগ্যতা নিয়ে। মূলত লড়াইয়ের শুরুটা গেল জেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। চেয়ারম্যান পদে এ দুই নেতা আলাদা দুই প্রার্থীকে সমর্থন করেছিলেন। মতিউর রহমান সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি তিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টির এমপি মমতাজ ইকবালের মৃত্যু হলে পরবর্তীতে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে যান মতিউর রহমান। এ প্রসঙ্গটি টেনে এনে মতিউর রহমানের যোগ্যতা নিয়ে প্রথম প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলেন সুনামগঞ্জ-৩ আসনের এমপি অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান। ১০ই জানুয়ারি দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় এক অনুষ্ঠানে এম এ মান্নান বলেন, ‘সে এক উপনির্বাচনে পাস করে এমপি হয়েছিল। সে মনে করেছে বিরাট কিছু হয়ে গেছে।’
মতিউর রহমানের আদি নিবাস সুনাগঞ্জের পাশের কিশোরগঞ্জ জেলায়। এ পরিচয়টা সুনামগঞ্জের রাজনীতিতে মতিউর রহমানকে অনেক সময়ই বেকায়দায় ফেলে দেয়। ছোটখাটো পর্যায়ে অনেকে এটিকে আলোচনার খোরাক বানালেও শীর্ষ পর্যায়ে এ নিয়ে কখনো প্রকাশ্য আলোচনা হয়নি। ১০ই জানুয়ারির জনসভায় এম এ মান্নান প্রথম বিষয়টিকে বড় পরিসরে টেনে আনেন তার বক্তব্যে। সেদিন তিনি বলেছিলেন, আমি দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ডুংরিয়ার সন্তান। ডুংরিয়াতেই থাকবো। ভৈরব থেকে এসে কৃত্রিম নেতা সাজবো না।
পাল্টা জবাব দিতে বেশি সময় নেননি মতিউর রহমান। দুদিন পর ১৬ই জানুয়ারি জেলা পরিষদের নতুন চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুটের জন্য অনুষ্ঠিত নাগরিক সংবর্ধনায় সাবেক এমপি মতিউর রহমানও প্রশ্ন তোলেন বর্তমান এমপি এম এ মান্নানের যোগ্যতা নিয়ে। তিনি বলেন, তিন বছর আগে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-৩ আসনে জগন্নাথপুর উপজেলায় মরহুম আবদুস সামাদ আজাদের ‘নাবালক’ ছেলে আজিজুস সামাদ ডনের কাছে ১০ হাজার ভোটে পরাজিত হলেও পরে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ভোটে এমপি নির্বাচিত হন এম এ মান্নান। বক্তব্যে ভোট কারচুপির ইঙ্গিতও দেন মতিউর রহমান। সেদিনের সে বক্তব্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এম এ মান্নানের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মতিউর রহমান। মতিউর রহমান বলেন, ‘একাত্তরে আমরা যখন যুদ্ধের ময়দানে ছিলাম, মান্নান সাহেব তখন পাকিস্তানিদের হেফাজতে চাকরি করেছেন।’
দুই নেতার বাকযুদ্ধের সূত্রে যুদ্ধের মাঠে নেমেছেন তাদের অনুসারীরাও। তারাও পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা করেছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন মতিউর রহমানের পঁচাত্তর পরবর্তী ভূমিকা নিয়ে। আর মতিউর রহমানের অনুসারীরা এম এ মান্নানকে হাইব্রিড নেতা হিসেবে চিহ্নিত করে বলছেন, সুনামগঞ্জের রাজনীতিতে তিনি উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন। কথার লড়াই ছাড়িয়ে দুপক্ষের অনুসারীরা মাঠেও নেমেছেন। প্রতিদিনই সুনামগঞ্জের রাজপথ কেঁপে উঠেছে দুই নেতার পরস্পরবিরোধী স্লোগানে। পুড়েছে মতিউর রহমানের কুশপুতুলও।
সর্বশেষ শনিবার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা উন্নয়ন পরিষদের উদ্যোগী স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সংবর্ধনা সভায় দেয়া বক্তব্যে মতিউর রহমানকে ক্ষমা চাইতে বলেন এম এ মান্নান। না হলে মানহানির মামলা করবেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
দুই নেতার পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের সূত্রে এমন যুদ্ধংদেহী পরিবেশে বিব্রত সুনামগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতারা। দুই নেতার লড়াইয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে নিজের নাম উঠে আসায় সবচেয়ে বেশি বিব্রত দশম নির্বাচনে এম এ মান্নানের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুস সামাদ আজাদ ডন। মানবজমিনকে তিনি বলেন, তিন বছরের পুরনো ঘটনা টেনে এনে দলে বিভেদ সৃষ্টি করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, রাজনীতিতে মতভেদ থাকতেই পারে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে সেই মতভেদ যেন আমাদের আদর্শকে আঘাত করতে না পারে। তিনি বলেন, আমাদের মতভেদের কারণে বিরোধী আদর্শের হাতে যেন কোনো সুযোগ চলে না যায়। আজিজুস সামাদ ডন বলেন, আবদুস সামাদ আজাদ, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, দেওয়ান ফরিদ গাজী ভিন্ন ভিন্ন বলয়ে রাজনীতি করলেও তারা একই আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। ডন সামাদ বলেন, দলে বিভেদ সৃষ্টি না করে, দূরত্ব না বাড়িয়ে আমাদের সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত একই মঞ্চে থেকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে এগিয়ে নেয়া। সূত্রঃ মানবজমিন