শক্তি দেখাতে গিয়ে নিজেদের দুর্বলতাই প্রকাশ করে দিলো ভারত
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ মে ২০২৫, ৯:৩৯ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্কঃ
সাম্প্রতিক যুদ্ধে ভারত শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে গেছে। পরে ১০ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ‘পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক’ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
মার্কিন গণমাধ্যম বলছে, গোয়েন্দা তথ্যের ইঙ্গিত বাস্তবতার দিকে রূপ নেয়ার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং হোয়াইট হাউসের চিফ অফ স্টাফ সুসি ওয়াইলস জরুরি মধ্যস্থতার আহ্বান জানান। ভ্যান্স ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিপর্যয়কর ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
২০১৯ সালের এক মার্কিন গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে ২০২৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে একটি পারমাণবিক যুদ্ধ লাগতে পারে। এতে এক সপ্তাহেরও কম সময়ে নিহত হতে পারে ১২৫ মিলিয়ন পর্যন্ত মানুষ। ফলে মার্কিন কূটনীতিকে এই উন্মাদনাকে দ্রুত ও জোরালোভাবে প্রশমিত করতে বাধ্য করেছিল।
তবে ভারতের কিছু মহল ট্রাম্পের ঘোষণাকে ভিন্নভাবে দেখেছে। সাবেক ভারতীয় সেনাপ্রধান বেদ প্রকাশ মালিক এক্সবার্তায় লিখেছেন, ‘যুদ্ধবিরতি ১০ মে ২৫ : আমরা ভারতের ভবিষ্যৎ ইতিহাসের উপর নির্ভর করে জিজ্ঞাসা করেছি যে গতিশীল ও অগতিশীল পদক্ষেপের পর কোনো রাজনৈতিক-কৌশলগত সুবিধা যদি থাকে, তাহলে কী লাভ হয়েছে?’
সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়াইসি এক্সবার্তায় লিখেছেন, ‘আমি চাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী কোনো বিদেশী দেশের প্রেসিডেন্টের পরিবর্তে নিজেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করুক। আমরা সিমলা (১৯৭২) চুক্তির পর থেকে সবসময় তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছি। তবে এখন কেন সেটি মেনে নিচ্ছি? আমি আশা করছি, কাশ্মির সমস্যা আন্তর্জাতিকীকরণ করা হবে না। কারণ, এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’
ওয়াইসি সম্ভবত ট্রাম্পের একটি বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে শেষোক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। ট্রাম্প বলেছিলেন, ভারত ও পাকিস্তানের সাথে কাজ করতে ইচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্র। তিনি দেখতে চান যে অনেক বছরের অমীমাংসিত কাশ্মির বিষয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছা যায় কিনা।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুদ্ধবিরতির ঘোষণাকে ভারতের কেউ কেউ মার্কিন চাপের মুখে মোদি সরকারের পিছু হটার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে কাশ্মির নিয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাবকে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপে হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে বাস্তবতা প্রায়ই ধারণাকে ছাড়িয়ে যায়। ভারত দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পারমাণবিক শক্তিতে বলীয়ান আঞ্চলিক আধিপত্যের কথা বলে আসছে। কিন্তু ২২ এপ্রিল কাশ্মিরে রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) পরিচালিত গণহত্যার পর তার পদক্ষেপগুলো দুর্বলতা হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ফলে শক্তি জাহির করতে গিয়ে ভারতের প্রভাব হ্রাস পায়। অপরদিকে এটি পাকিস্তানের আঞ্চলিক অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করে এবং মোদির সরকারকে কূটনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেয়।
৭ মে ভারত টিআরএফ-এর মতো গোষ্ঠীগুলোর সাথে যুক্ত উগ্রবাদীদের ঘাঁটি ধ্বংস করতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে। ফরাসি রাফায়েল জেট ব্যবহৃত এই অভিযানটির মাধ্যমে মোদি সরকার তার শক্তিশালী ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতা প্রকাশ পায়।
পাকিস্তানের বিমান বাহিনী আক্রমণ প্রতিহত করতে নিজস্ব জেট ব্যবহার করে। তারা দাবি করে যে তারা তিনটি রাফায়েলসহ পাঁচটি ভারতীয় জেট ভূপাতিত করেছে। দুই মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছেন যে চীনা গোয়েন্দা, নজরদারি ও পুনর্বিবেচনা (আইএসআর) সহায়তায় পরিচালিত একটি চীনা তৈরি জে-১০ জেট অন্তত দু’টি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করেছে। তবে ভারত কোনো ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করেনি।
ভারতীয় গণমাধ্যম প্রাথমিকভাবে করাচির সমুদ্রবন্দরসহ পাকিস্তানি শহরে বিধ্বংসী হামলার দাবি করেছিল। কিন্তু এই প্রতিবেদনগুলো ভুল প্রমাণিত হয়।
ভারত ৯ মে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এর মধ্যে ইসলামাবাদের কাছাকাছিও একটি হামলা করেছিল বলে পাকিস্তান দাবি করেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী উধমপুর, পাঠানকোট, আদমপুর ও ভূজে ভারতীয় বিমান ঘাঁটি লক্ষ্য করে স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়। ভারতীয় বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা ব্যোমিকা সিং জানিয়েছেন, পাকিস্তানি ড্রোন ও গোলাবারুদ বেসামরিক ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে।
এই যুদ্ধে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারকারী হিসেবে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ভারত সরকার স্পষ্টতই তার রাফায়েল জেটগুলোকে অতিমূল্যায়ন করেছে। পাকিস্তানের চীন-সমর্থিত আইএসআর সিস্টেমকে অবমূল্যায়ন করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানের প্রতি চীনের সামরিক সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সাল থেকে ইসলামাবাদের সামরিক আমদানির ৮১ শতাংশই এসেছে চীন থেকে।
বছরের পর বছর ধরে কিছু ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক সতর্ক করে আসছিলেন যে ভারতের সামরিক বাহিনী চীন-সমর্থিত পাকিস্তানের জন্য প্রস্তুত নয়। কারণ তাদের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাশ্মির জুয়ার জন্য সীমিত মার্কিন বা রাশিয়ার সমর্থন রয়েছে। অন্যরা চীন-পাকিস্তান পুনর্মিলন উৎসাহিত করার জন্য সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করেছিলেন। নয়াদিল্লিতে এসব সতর্কবার্তা অগ্রাহ্য করা হয়েছিল।
গত কয়েক দিনের ঘটনাবলী ভারতের কৌশলগত সীমাবদ্ধতা উন্মোচন করেছে এবং বিশ্বব্যাপী তদন্ত শুরু করেছে। নয়াদিল্লির প্রতিক্রিয়া হতে পারে প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি ও কাশ্মিরের সামরিকীকরণ আরো গভীর করা।
ভারত সরকার যখন পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা করছে, তখন এটি বিবেচনা করা উচিত যে ছায়াযুদ্ধের স্থিতাবস্থা এবং অস্থিরতা উস্কে দেয়ার গোপন আগ্রাসনের চক্র অস্থিতিশীল। উভয় দেশের গোয়েন্দা সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে প্রক্সিদের সমর্থন করে আসছে, যা কাশ্মির থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত অস্থিরতা ডেকে আনছে।
নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের ওপরই ভবিষ্যতের পথ নির্ভর করছে। বাকপটুতা নয়, সংযমই নীতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। তা না হলে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং লাখ লাখ মানুষের জন্য দুর্ভোগের ঝুঁকি বাড়বে। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ দরিদ্র মানুষ এবং ৩৫ কোটিরও বেশি নিরক্ষর প্রাপ্তবয়স্কের আবাস ভারত ও পাকিস্তান দীর্ঘস্থায়ী সঙ্ঘাতের ভার বহন করতে পারবে না। অব্যাহত উত্তেজনা ভারতের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে, যা যেকোনো কৌশলগত অর্জনকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।
সূত্র : আল জাজিরা