সাবেক মন্ত্রী মান্নানের শেল্টারে ফয়সলের সম্পদের পাহাড়
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ
ওয়েছ খছরুঃ
জগন্নাথপুরের কলকলিয়া আওয়ামী লীগ নেতা ফয়সল মিয়া। বিগত ১৫ বছর মন্ত্রী এমএ মান্নানের শেল্টারে এখন কোটিপতি এই নেতা। নিজ বাড়ি শ্রীধরপাশা ও সিলেট নগরের আখালিয়া তপোবন এলাকায় গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। বিগত দিনে তার ক্ষমতার দাপটের কাছে অসহায় ছিল জগন্নাথপুরের প্রশাসনও। মামলা বাণিজ্য, জলমহাল দখল, মানবপাচারসহ নানা ঘটনায় এখন জগন্নাথপুর জুড়েই ভাসছে ফয়সলের নাম। এতসবের পরও ফয়সলের দাপট এখনো কমেনি। ৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পরদিন ৬ই আগস্ট বিএনপি’র নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছেন তিনি। তবে, মন্ত্রী এমএ মান্নান গ্রেপ্তারের পর এখন মন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব ও আরেক দুর্নীতিবাজ হাসনাত হোসেন ও ফয়সলসহ তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা গা-ঢাকা দিয়েছে। শান্তিগঞ্জ ও দিরাই অংশের জগন্নাথপুরের শেষের ইউনিয়ন হচ্ছে কলকলিয়া। এ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ফয়সল মিয়া। আগে ফয়সল নিজের গ্রামে ধানের ব্যবসা করতেন। ভাইয়েরা লন্ডনে থাকায় শ্রীধরপাশা গ্রামের বাড়িতে একতলা একটি বিল্ডিং ছিল। সম্পদ বলতে তেমন কিছুই ছিল না। কিন্তু সরকার ক্ষমতায় আসায় ২০০৯ সালের এমপি ও পরবর্তীতে পরিকল্পনামন্ত্রী হওয়া এমএ মান্নানের খাস লোক হিসেবে পরিচিতি পান ফয়সল মিয়া। ২০১১ ও ২০১২ সাল থেকে শুরু হয় দাপট দেখানো। চন্ডিঢর ও কচুয়ার জাওর জলমহাল নিয়ে ফয়সল শুরু করেন রাজনীতি। বিবদমান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও মামলার সৃষ্টি করে ৩ উপজেলার শীর্ষ এ দু’টি জলমহাল নিজের দখলে নিয়ে নেন ফয়সল মিয়া। প্রায় এক যুগ ধরে এ দু’টি জলমহালের কর্তৃত্ব ধরে রেখে কোটি কোটি হাতিয়ে নিয়েছেন ফয়সল।
স্থানীয় মৎসজীবীরা জানিয়েছেন, মন্ত্রীর লোক হওয়ার কারণে জলমহাল নিয়ে সব দ্বন্দ্ব ও মামলা নিজের দায়িত্বে নিয়ে ফয়সল কর্তৃত্ব দেখানো শুরু করেন। প্রতি বছর এ দু’টি জলমহালে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকার মাছ বিক্রি করা হয়। গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গ্রামের তাদের বাড়ি ছিল একতলা। প্রায় ৮ বছর আগে গ্রামের বাড়ি দোতলা করেছে। বাড়ির সামনে এক মুক্তিযোদ্ধার জমিসহ প্রায় ১০০ শতাংশ ভূমি দখলে নিয়ে মাটি ভরাট করে সীমানার ভেতরে ঢুকিয়েছে। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মামলা রয়েছে। নিজ গ্রামে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের আমেনা ডেইরি ফার্ম নামের একটি গরুর ফার্ম রয়েছে। মামলার জর্জরিত এলাকার লোকজনের পশু জোরপূর্বক এ ফার্মে এনে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সিচনী গ্রামের রুহুলের স্ত্রী রিপা বেগম জানিয়েছেন, তাদের মালিকানাধীন শতাধিক পশু জোরপূর্বক নেয়া হলেও মন্ত্রীর প্রভাব থাকায় ফয়সলের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা নেয়নি। এখন তাদের পক্ষ থেকে আদালতে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি। সিলেট শহরের আখালিয়া তপোবন এলাকায় রয়েছে ফয়সলের একটি দোতলা বাড়ি। নিজ এলাকায় টাকা কামিয়ে প্রায় ৭ বছর আগে ফয়সল কয়েক কোটি টাকা মূল্যের এই বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এখন তিনি ওই বাড়িতে বসবাস করেন। নগরের নাইওরপুল পয়েন্টে তার মালিকানাধীন দু’টি দোকান রয়েছে। এ ছাড়া নামে-বেনামে আরও বহু সম্পত্তি রয়েছে।
এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, গত ২০১৭ সালে শ্রীধরপাশা মাদ্রাসার জমি নিলামকে কেন্দ্র করে জগন্নাথপুর উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য জাবেদ আলম কোরেশী গোষ্ঠীর সঙ্গে ফয়ছল বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনার সময় নিরীহ ব্যক্তি নুর আলীকে ফয়সল নিজে গুলি করে আহত করে। পরে নুর উদ্দিন আলী মারা গেলে নগরের তপোবনের বাসায় স্ত্রীকে আটকে রেখে আরেক যুবক আবুল খয়েরকে বাদী করে বিএনপি নেতা জাবেদ কোরেশী, সেচ্ছাসেবক দল নেতা জুনেদ আহমদসহ কয়েকজনকে আসামি করে থানায় মামলা করে। পরে নুর আলীর স্ত্রী ফয়ছলের বাসা থেকে পালিয়ে এসে ফয়সলকে আসামি করে সিলেট কোতোয়ালি থানায় অপহরণ মামলা করেন। সুনামগঞ্জ আমলি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ফয়ছলকে প্রধান আসামি তার স্বামী নুর আলীকে হত্যার দায়ে মামলা করেন।
স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা জুনেদ আহমদ জানিয়েছেন, ফয়সল নিজে হত্যা করে উল্টো হত্যা মামলায় আমাদের আসামি করে জেলে দিয়েছে। মন্ত্রীর শেল্টারে তখনকার প্রশাসনকে প্রভাবিত করে এ ঘটনা ঘটায়। তিনি জানান, অনেক অপরাধের গডফাদার এই ফয়সল। অথচ প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পরও আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিয়ে ৬ই আগস্ট আমাদের বাড়িঘরে হামলার চেষ্টা করে। এলাকার যুবক এমরানের মালিকানাধীন ফয়সলের বাড়ির পাশে ৬৩ শতক জায়গা জোরপূর্বক দখল নিয়েছে। চন্ডিঢর জলমহালের ব্যবসার হিসাব নিয়ে এমরানের সঙ্গে ফয়সলের বিরোধ সৃষ্টি হয়। এর জের ধরে এমরানকে সুকৌশলে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করে ফয়ছল। পরবর্তীতে এমরানের বোন সুমেনা বেগম বাদী হয়ে এমারনকে হত্যার দায়ে ফয়সলকে আসামি করে ঢাকার সিএমএম কোর্টে হত্যা মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি পিবিআই ঢাকাকে তদন্তের আদেশ দেন। পিবিআই’র তৎকালীন ডিআইজি বনজ কুমারকে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সরাসরি ফোনে ফয়সলের বিষয়ে তদবির করলে ডিআইজি বনজ কুমার ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে মামলটি অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে আদালতে রিপোর্ট দেন। এমরানের লন্ডনে থাকা স্বজনরা জানিয়েছেন, তারা হত্যা মামলার ন্যায়বিচার পেতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে এসে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মানবপাচারে জড়িত ফয়সল আহমদ। লিবিয়ায় তারই এলাকার এনাম, শাহীনসহ কয়েকজনের সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়েছে। এলাকার লোকজনকে লিবিয়ায় নিয়ে আটকে রেখে দেশে থাকা ফয়সলের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করা হয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে লিবিয়ায় বন্দিদশা থেকে দেশে ফেরা শ্রীধরপাশা গ্রামের মাহবুব হোসেন গতকাল বিকালে জানিয়েছেন, ফয়সল ও তার সিন্ডিকেটরা তাকে লিবিয়ায় আটকে রেখে ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়েছে। তিনি বাড়ি বিক্রি করে ওই টাকা পরিশোধ করে দেশে আসেন। এরপর টাকার জন্য চাপ দিলে উল্টো তাকে একটি মানবপাচার মামলার আসামি করা হয়েছে। তিনি জানান, সিলেটের শতাধিক যুবক ফয়সল চক্রের কাছে প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ রফিক মিয়া জানিয়েছেন, মন্ত্রীর নিজের লোক হিসেবে ফয়সল এলাকায় অনেক কিছুই করেছেন। মানবপাচারের ঘটনায় টাকা আত্মসাতসহ নানা বিষয়ে তার পরিষদে বিচার হয়েছে। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পরও বিএনপি’র নেতাকর্মীর বাসায় হামলার চেষ্টা চালানো হয় বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ফয়সল গতকাল বিকালে কাছে তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে তিনি নিজে স্বীকার করেছেন বিগত সময়ে তার বিরুদ্ধে ৩০-৩৫টি মামলা দায়ের করা করেছে। তিনি জেলও খেটেছেন। ফয়সল জানান, তিনি মানবপাচার, জলমহাল দখল কিংবা এলাকায় কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তাকে মিথ্যা মামলায় বিভিন্ন সময় ফাঁসানো হয়েছে। তবে সাবেক মন্ত্রী এমএ মান্নানের সঙ্গে সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন তিনি। -মানবজমিন