সিলেটে টর্চার সেলে খুন হন আবুল হাসান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুন ২০২৪, ১০:১৪ অপরাহ্ণ
ওয়েছ খছরু:
সিলেটের আম্বরখানার পয়েন্টের পাশেই একটি চারতলা বাসা। ঠিকানা ওয়েভস বি/১৭/১। চারতলার ছাদের উপরে টর্চার সেল খুলে এলাকার চিহ্নিত হেলাল ওরফে রনি। তার বাসা নগরের হাউজিং এস্টেটে। যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত সে। মূল নাম রনি হলেও ছদ্মনাম হেলাল ব্যবহার করেই সে ওই টর্চার সেলের নেতৃত্ব দিতো। আর এই টর্চার সেলেই খুন হয়েছেন গোলাপগঞ্জের ভাদেশ্বরের যুবক আবুল হাসান। এরপর থেকে আলোচিত হচ্ছে হেলালের এই টর্চার সেল। কিন্তু খুনের ঘটনার আগে থেকেই স্থানীয়রা জানতেন এই টর্চার সেলে কী হয়। টর্চার সেলের সদস্য ১৫-১৬ জন যুবক।
হেলাল ওরফে রনিই হচ্ছে মূল নিয়ন্ত্রক। তার সঙ্গে আছে খুনের মামলায় জেল খাটা আসামি শাকিল, মিথুন, রাজুসহ কয়েকজন চিহ্নিত অপরাধী। গোলাপগঞ্জের ভাদেশ্বর এলাকার কালাশহর গ্রামের বাসিন্দা আবুল হোসেন। তরতাজা যুবক আবুল পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অন্তঃসত্ত্বা বোন নগরের জিন্দাবাজারের মাতৃমঙ্গল হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এ কারণে বোনকে দেখতে ঈদের পর দিন ১৮ই জুন রাতে চাচাতো ভাই মিনহাজকে নিয়ে সিলেট শহরের পথে রওয়ানা দেন। ভাদেশ্বর সিএনজি স্টেশন থেকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় ওঠেন তারা দু’জন। পথিমধ্যে এক যুবক অটোরিকশা থেকে নেমে আরেকজন ওঠেন। নগরের কদমতলী এলাকায় আসার পর অটোচালক জানান তিনি আম্বরখানা যাবেন। তারা চাইলে সঙ্গে যেতে পারেন। এ কথা শুনে রাজি হয়ে যান আবুল ও মিনহাজ। পথিমধ্যে তাদের সিএনজি অটোরিকশাতে ওঠেন আরও এক যুবক।
মিনহাজ জানান; নগরের জিন্দাবাজারে আসার পর তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কিছু বলতে পারেননি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তার যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখেন তিনি একটি বাসার ৫ তলার ছাদে। সঙ্গে রয়েছে ভাই আবুল হাসান। তাদের ঘিরে আছে ১০-১২ জন যুবক। এ সময় ওই যুবকরা তাদের কাছ থেকে মোবাইল টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয়। এক পর্যায়ে মুক্তিপণ হিসেবে আরও টাকা পাঠানোর জন্য স্বজনদের ফোন দিতে বলে। কিন্তু তারা ফোন দিচ্ছিলেন না। এ সময় তাদের ওখানে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। বেশি নির্যাতন করা হয় আবুল হাসানকে। তিনি জানান- ওই যুবকদের হাতে ছুরিসহ নানা অস্ত্র ছিল। এবং সবাই মিলে তাদের মারধর করে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে কয়েকজন যুবক আবুলকে মারধর করে। একপর্যায়ে ৪ তলার উপর থেকে নিচে ফেলে দেয়। এ সময় ওই যুবকরা একেক করে নিচে চলে যায়। তিনি জানান; নিচে পড়ার পর তিনি দেখেন আবুলের শরীরে রক্ত ঝরছে। সে কথা বলতে পারছিল না। কোন এলাকায় তারা আছেন সেটিও বলতে পারেন না। পরে আবুলকে নিয়ে পাশের রাস্তায় এসে দেখেন সে স্থান নগরের আম্বরখানা। তাৎক্ষণিক আবুলকে পাশের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখান থেকে ওসমানীতে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত দেড়টার দিকে মারা যান আবুল হাসান।
এদিকে- ঘটনার পর সিলেটের কোতোয়ালি থানা পুলিশ স্থানীয়ভাবে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে। তদন্তে তারা নগরের কাজিটুলার মক্তবগলির রায়হান আহমদ নামের একজনের সন্ধান পায়। পরে পুলিশ রোববার ভোররাতে ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে রায়হানকে আটক করে। গ্রেপ্তারের পর রায়হান পুলিশের কাছে খুনের ঘটনা স্বীকার করেছে। ঘটনার সঙ্গে কারা কারা জড়িত সেটিও বলেছে। এরপর সোমবার সিলেটের আদালতে খুনের ঘটনার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিও দিয়েছে। কোতোয়ালি থানার ওসি মঈন উদ্দিন শিপন গতকাল বিকালে জানিয়েছেন- আটক রায়হানের কাছ থেকে খুনের ঘটনায় জড়িতদের নাম পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ঘটনায় যারা জড়িত তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানান তিনি। মামলা সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছে; খুনের ঘটনার পর এখন অনেকেই এলাকায় নেই। রায়হান গ্রেপ্তারের পর সবাই পালিয়ে গেছে। তারা কোথায় আছে সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। নগরের আম্বরখানার হেলালের ওই টর্চার সেল এক নামেই চিনেন সবাই। হোটেল হিমেলের গলির ভেতরে ওই চারতলা বাসা। বাসার মালিক শামসুল ইসলাম বসবাস করেন আমেরিকায়। বাসার দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন হোটেল হিমেলের ম্যানেজার। ভাড়াও তোলেন তিনি। চারতলা বাসার বেশির ভাগ ফ্ল্যাটে বসবাস করেন ব্যাচেলররা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন; দু’তলার একটি ফ্ল্যাটে কয়েকজন মহিলা থাকেন। বছর খানেক আগে ওই এলাকার উল্টো দিকের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিহত বিএনপি নেতা আফম কামালের সঙ্গে কয়েকজনের দ্বন্দ্ব হয়েছিল। এ ঘটনার জের ধরে পরবর্তীতে আফম কামাল খুন হন। এরপর থেকে ওই আস্তানার অপরাধীরা এ বাসায় এসে অবস্থান নেয়। সন্ধ্যা হলেই তারা বসে ওখানে আড্ডা দেয়। শাকিল, হেলাল ওরফে রনি, মিথুন, রাজুসহ কয়েকজন সিনিয়র হিসেবে টর্চার সেলের নেতৃত্ব দেয়। মূল নেতৃত্বে রয়েছে হেলাল। আর আস্তানার জুনিয়ররা নানা ঘটনা ঘটায়। স্থানীয় পরিবহন শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- প্রতিদিনই ওই আস্তানায় লোকজনকে ধরে নিয়ে আসা হয়। এরপর তাদের নিয়োজিত মহিলাদের এনে লোকজনের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তোলা হয়। ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে। যারা মুক্তিপণ দেয় না তাদের বাসার ছাদে হাত-মুখ বেঁধে মারধর করা হয়। প্রতিদিনই ওখানে এসব ঘটনা ঘটে। এলাকার লোকজন ভয়ে কেউ খোলেন না। আবুল হাসান খুনের ঘটনার পর এ ধরনের কয়েকটি ঘটনার অভিযোগ পুলিশের কাছে পৌঁছেছে। নানা ভাবে মানুষের কাছ থেকে টাকা লুট করে তারা আস্তানায় নিয়ে যেতো। আম্বরখানা এলাকার সব অপরাধও এই আস্তানায় বসে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। হোটেল হিমেলের সহকারী ম্যানেজার সেলিম আহমদ জানিয়েছেন; বাসার কেয়ারটেকারের দায়িত্বে রয়েছেন মূল ম্যানেজার আব্দুল আহাদ। বাড়িতে পানি উঠায় তিনি ঈদের কয়েকদিন বাড়িতে ছিলেন। তবে; বাসার ছাদে কেউ বসে আড্ডা দেয় কিনা, কিংবা ওই এলাকাকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করা হয় কিনা- সে ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। কর্তৃপক্ষ হিসেবে তাদের কেউ বিষয়টি অবগত করেননি বলে জানান তিনি।