সড়কের রাজা মালিক-শ্রমিকরাই, ভাড়া ঠিক করছেন নিজেরা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ অক্টোবর ২০২২, ৯:০২ অপরাহ্ণ
সুরমা নিউজ ডেস্ক:
ঢাকায় গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায় কিছুতেই থামছে না। ক্রমেই বাসে বাসে ছড়িয়ে পড়ছে বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রবণতা। এতে দিশাহারা যাত্রীরা। প্রতিনিয়তই যাত্রীদের পকেট কেটে বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন পরিবহন শ্রমিকরা। এ নিয়ে বাসে বাসে চলে বাকবিতণ্ডা। নানা সময়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। হয়েছে প্রাণহানিও। সরকার ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও তা মানতে নারাজ বাস শ্রমিকরা। ফলে গণপরিবহনের নৈরাজ্য বাড়ছেই। পরিবহন মালিক সমিতি কয়েক মাস আগে ওয়েবিল বন্ধ ঘোষণা করলেও কেউ শুনছেন না কারও কথা।
সরজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করা অধিকাংশ বাসের ভাড়ার তালিকা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। কোনো কোনো বাসে তালিকা থাকলেও তা দেখে ভাড়া নেয়া হচ্ছে না। আগের সেই ওয়েবিল পদ্ধতিতেই বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। রাজধানীর খিলগাঁও-বাসাবো থেকে মতিঝিল-শাহবাগ হয়ে মিরপুর যায় বাহন পরিবহন। বাসাবো থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত অসংখ্য যাত্রী চলাচল করে। চার্ট অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত ভাড়া ১০ টাকা হলেও যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া হয় ১৫ টাকা। শাহবাগ পর্যন্ত ২০ টাকা হলেও নেয়া হয় ২৫ টাকা। এভাবে প্রতি স্টপেজেই বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে যাত্রীদের। প্রতিদিন বাসাবো থেকে মতিঝিল যাতায়াত করেন ব্যবসায়ী সজল আলম। তিনি বলেন, মতিঝিল পর্যন্ত চার্টে ভাড়া ১০ টাকা।
আমাদের থেকে নিচ্ছে ১৫ টাকা। জিজ্ঞেস করলে বলে এটা কোম্পানি করে দিয়েছে। কোম্পানির সঙ্গে কথা বলতে বলে। আমরা বাসে কোম্পানির লোক কোথায় পাবো। বাহন বাস চালকের সহকারী সাগর বলেন, আমি চাই ১৫ টাকা। কেউ ১০-১২ টাকা দেয়। কোম্পানির সিটিং হিসাবে ১৫ টাকা চাই। ওই রুটের মিডলাইন বাসেও বাড়তি ভাড়া গুনতে হয় যাত্রীদের। নাজমুল করিম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন। চাকরির কাজে ধানমণ্ডি থেকে বাহন পরিবহনে করে গুলিস্তান যাচ্ছেন। গণপরিবহনে যাতায়াত করতে তিনি কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, গণপরিবহনে সবসময়ই গাদাগাদি করে যাত্রী বহন করা হয়। অনেক সময় বাসে উঠে দাঁড়ানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। প্রায় সময় পা দেয়ার মতো জায়গাও থাকে না। তাও হেলপার যাত্রী তুলতে থাকে। যাত্রীরা অনেক সময় ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে ড্রাইভারকে গালিগালাজও করে। এতেও ড্রাইভার বাস না চালিয়ে উল্টো যাত্রীকেই বাস থেকে নেমে যাওয়ার হুমকি দেয়। মাঝে মধ্যে হেলপারকে অনেক যাত্রী গায়ে হাত তুলেও বসে। সেই সময়ে তারাও যাত্রীদের উপর চড়াও হয়। অনেক সময় বাস চালানো বন্ধ করেও দেয়। যাত্রীরা আবার সমস্যা মিটমাট করে তাদের নিকট মাফ চায়, এতে তারা বাস চালাতে সম্মত হয়। যাত্রীরা একরকম তাদের নিকট জিম্মি।
রাজধানীর সাইনবোর্ড-যাত্রবাড়ী-বৌদ্ধমন্দির-ফার্মগেট-গাবতলী-সাভার রুটে চলাচল করে লাব্বাইক পরিবহন। সরকার থেকে ওয়েবিল পদ্ধতি বাতিল করতে বললেও বাসটিতে তা চলমান রয়েছে। বৌদ্ধমন্দির ওয়েবিলের জন্য ১৫ টাকা ও মগবাজার ওয়েবিলের জন্য ১০ টাকা ভাড়া নেয়া হয়। কেউ বৌদ্ধমন্দির থেকে কারওয়ান বাজার কিংবা বাংলামোটর পর্যন্ত গেলেই দিতে হয় ২৫ টাকা। যদিও কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া আসে ১৭ টাকা। এ ব্যাপারে বৌদ্ধমন্দির ওয়েবিল চেকার রাকিব বলেন, ২৫ টাকা চাইলেও কেউ দেয় না। ২০ টাকাই দেয় সবাই। মৃদুল ইসলাম ফার্মগেটে অবস্থিত একটি প্রতিষ্ঠানে ওয়েব ডিজাইনিংয়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সেখান থেকে লাব্বাইক পরিবহন নামের একটি বাসে শ্যামলী আসছেন। বাস থেকে নেমে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ফার্মগেট থেকে শ্যামলী পর্যন্ত ৪ কিলোমিটারের পথ। প্রতি কিলোমিটারের হিসেবে ভাড়া হওয়ার কথা ছিল ১০ টাকা। অথচ খামারবাড়ীতে এই বাসের একজন ওয়েবিল চেকার আছেন। আমি যে দূরত্বেই যাই না কেন, এই চেকার পার হলে ১৫ টাকা করে দিতেই হবে। এ নিয়েই হয় যতো সমস্যা। যাত্রীরা কেন বেশি ভাড়া দেবে? এই প্রশ্ন তাদের করলে বলে এটা তাদের কোম্পানি জানে।
কোম্পানি তাদের যেভাবে নির্দেশ দিয়েছে তারা সেভাবেই ভাড়া কাটছে। দিতে না চাইলে তারা বাস থেকে নামিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। কখনো আবার নামিয়েও দেয়। এই রুটে লাব্বাইক বাদেও ওয়েলকাম পরিবহনের বাসও চলে। বাসের ড্রাইভার-হেলপাররা তো কোনো কথা শুনতেই চায় না। তাদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়ালে অশ্রাব্য-অশ্লীল শব্দের ব্যবহার করে। তারা অনেক আগে থেকেই এভাবে সিন্ডিকেট করে আসছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়েবিল চেকার বলেন, বাস মালিকদের নির্দেশেই আমরা কাজ করি। আমাদের নির্ধারিত কোনো বেতন নেই। বাস থেকে বেতনের টাকা তুলি। চেকিং পয়েন্টের পরে বাড়তি ভাড়া গুনতে হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। আমরা শুধু যাত্রীর হিসাব রাখি। ভাড়া কম বেশি নেয়া চালক-হেলপারের কাজ। নির্ধারিত কোম্পানির বাস দেখাশোনার জন্য আমরা রাস্তায় কাজ করছি। বাসে কতজন যাত্রী আছে, কতক্ষণ পর আসছে এসব দেখাশোনা করতে হয়। এজন্য গাড়ি থেকে প্রতি ট্রিপে ১০ টাকা করে দেয়া হয়। সাকিব হোসেন। বই কিনতে শ্যামলী থেকে নীলক্ষেত যাচ্ছেন। উঠেছেন ঠিকানা পরিবহনে। কিছুদূর যাওয়ার পরে বাসের সুপারভাইজার তার নিকট ভাড়া নিতে আসেন।
সাকিব নিজেকে শিক্ষার্থী দাবি করে হাফ ভাড়া দেয়। প্রথমে সুপারভাইজার তার দেয়া ভাড়া নিতে অস্বীকার করে সাকিবের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র দেখতে চায়। এরপর পরিচয়পত্র দেখিয়ে সাকিব রেহাই পায়। নীলক্ষেত মোড়ে নামলে সাকিবের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। সাকিব বলেন, গণপরিবহনে এমন হয়রানির ঘটনা অহরহ। আমরা যে শিক্ষার্থী সেটা কোনোভাবে বাসের সুপারভাইজাররা বিশ্বাস করতে চায় না। সবসময় তো আর পরিচয়পত্র নিয়ে বের হই না। তখন আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় বিপাকে। আমার বাসা শ্যামলী, সেখান থেকে ঢাকা কলেজের দূরত্ব সাড়ে ৫ কিলোমিটারের একটু বেশি। আগে যে কাউকে শ্যামলী থেকে ঢাকা কলেজে আসতে ১০ টাকা ভাড়া গুনতে হতো। আমরা সেই সময়ে শিক্ষার্থী দাবি করে তাদের ৫ টাকা ভাড়াও দিয়েছি। এখন ভাড়া বাড়িয়ে ১৫ টাকা করেছে। সেই হিসাবে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া হয় সাড়ে ৭ টাকা। তা তো এরা কখনো নেয় না, ন্যূনতম ভাড়া ১০ টাকা দিতে হয়। যেকোনো সিগন্যালে আসার আগে ড্রাইভার অনেক সময় গাড়ি ধীরে চালায়, যেন ইচ্ছা করে সিগন্যালে পড়তে পারে। যাত্রীরা কিছু বললে তারা কানেই নিতে চায় না। তাদের নিকট আমরা জিম্মি।
বাসে ভাড়া নৈরাজ্যের প্রতিবাদ করলে বাস মালিকরা হুমকি দেয় উল্লেখ করে যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, আমরা প্রতিবাদ করলে মালিকরা হুমকি দিচ্ছে মামলা করবে। সরকারও তাদের সঙ্গে সুর মেলায়। এসব অনিয়ম বন্ধের দায়িত্ব সরকারের। সরকার যখন মালিকের পকেটে ঢুকে পড়ে, মালিকের স্বার্থ রক্ষা করে তখন জনস্বার্থ দেখার জন্য কেউ থাকে না। ফলে নৈরাজ্য আরও বেশি উষ্কে দেয়া হয়। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, বাস ভাড়ার নৈরাজ্য কমাতে আমরা চেষ্টা করছি। বাস মালিকদেরকে ডেকেছি। তাদের সঙ্গে আলাপ করে চেষ্টা করছি। সময় লাগবে। বাস মালিকদের ইতিবাচক-নেতিবাচক সাড়া রয়েছে।