২ হেভিওয়েট প্রার্থী নিয়ে নতুন আলোচনা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জানুয়ারি ২০২২, ২:১০ অপরাহ্ণ
বিল্লাল হোসেন রবিন, নারায়ণগঞ্জ থেকে:
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই দুই হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার ও ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে ঘিরে নতুন নতুন আলোচনা সামনে আসছে। আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থন নিয়ে ডা. আইভী নির্বাচন করলেও শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন বিএনপি নেতা তৈমূর আলম। বিএনপি সরাসরি তাকে সমর্থন না দিলেও দলের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হওয়ায় বহিষ্কারও করেনি। এছাড়াও বিএনপির কিছু নাটকীয় সিদ্ধান্ত ভাবিয়ে তুলেছে তৈমূরের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগকে।
বিভিন্ন তথ্যমতে, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে বিএনপি সিটি নির্বাচনে আসবে কি আসবে না। আর যদি আসে তাহলে বিএনপি থেকে কে প্রার্থী হবেন তা নিয়েও আলোচনার কমতি ছিল না নগরবাসী তথা প্রতিপক্ষ শিবিরে। যদিও পূর্বেই বিএনপি ঘোষণা দিয়েছিল বর্তমান নির্বাচন কমিশনের আওতায় তথা এই সরকারের আমলে স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না। বিএনপির এই কথায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে নাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে।
তারা রীতিমত নিশ্চিত হয়ে যান দলীয় মনোনয়ন পেলেই বিজয়ী। তাই নাসিকের সদ্য সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ভিপি বাদল, মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি চন্দন শীল ও সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা দলীয় মনোনয়নত্রপত্র কিনেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড এককভাবে দলীয় মনোনয়ন দেন সেলিনা হায়াৎ আইভীকে। ক্ষোভ ও হতাশায় নিমজ্জিত হয় আওয়ামী লীগের বাকি তিন প্রার্থী।
এদিকে দলীয় সমর্থন পেয়ে জেলা নির্বাচন অফিস থেকে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। কিন্তু নাটকীয়ভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিএনপির দুই নেতা মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান ও সাধারণ সম্পাদক এ্িটএম কামাল মনোনয়নপত্র কেনেন। তারা বলেন, আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কিনেছি। তবে দল যা সিদ্ধান্ত দেবে আমরা তা মেনে নেবো। শুরু হয় বিএনপির এই দুই নেতাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। বিএনপির নেতাকর্মীদের কেউ সাখাওয়াতের পক্ষে কেউ এটিএম কামালের পক্ষ নেন। আর আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর সমর্থকরা ধরেই নেন, সাখাওয়াত হোসেন খান বা এটিএম কামাল যিনিই প্রার্থী হন না কেন, আইভীর তুলনায় তারা অত্যন্ত দুর্বল প্রার্থী। কারণ ২০১৬ সালের নির্বাচনে সাখাওয়াত হোসেন বিএনপির ব্যানারে নির্বাচন করে আইভীর কাছে ৭৮ হাজার ভোটে হেরে যান। কিন্তু আইভী শিবির তথা আওয়ামী লীগ টের পাননি পর্দার আড়ালে অন্য খেলা অপেক্ষা করছে। হিন্দি ছবির সেই আলোচিত ডায়ালগের মতো‘ পিকচার আভি বি বাকি হ্যায় মেরি ভাই’।
ওদিকে ৫ই ডিসেম্বর সাখাওয়াত হোসেন খান ও এটিএম কামাল মনোনয়ন কেনার কয়েকদিন পরই হঠাৎ আলোচনায় আসে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার প্রার্থী হচ্ছেন। বিষয়টিকে নেগেটিভ-পজেটিভ দুইভাবেই নেয় বিএনপির একটি অংশ। তবে আইভী সমর্থকরা প্রচার করেন ওসমান পরিবারের ইন্ধনে মেয়র প্রার্থী হচ্ছেন তৈমূর আলম। শুরু হয় তাদের পরোচণায় তৈমূরকে নিয়ে মুখরোচক নানা কথা। এই যখন অবস্থা তখন আকস্মিকভাবে ১২ই ডিসেম্বর বিএনপির সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিনের পক্ষে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র কেনেন তার সমর্থকরা। এবার ভিন্ন আলোচনা ঢালপালা ছড়াতে থাকে। বলাবলি হয়, ওসমান পরিবার যদি তৈমূরকে মাঠে নামিয়ে থাকেন তাহলে কাউন্টার হিসেবে আইভী শিবির গিয়াস উদ্দিনকে মাঠে নামিয়েছে। এমন আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ১৩ই ডিসেম্বর তৈমূর আলম খন্দকার নিজে গিয়ে মনোনয়নপত্র কেনেন। এবার চায়ের টেবিলের আলোচনা অভিজাত রেস্তরাঁয় উঠে আসে। নগরীতে চাউর হয়ে যায় গিয়াস উদ্দিন মনোনয়নপত্র কিনলেও তিনি আইভীর প্রতিপক্ষ হবেন না। তারপরও কথা আছে, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’।
ফলে ১৫ই ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষদিনে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। ওইদিন বিএনপির ৪ জন মনোনয়নপত্র জমা দিলে ২৭শে ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো কে হচ্ছেন বিএনপি ঘরানার চূড়ান্ত প্রার্থী। চুলচেরা বিশ্লেষণ স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। কিন্তু গল্পের প্রথম অংশের পরিসমাপ্তি ঘটে ওইদিনই। নাটকীয়ভাবে বিএনপির ৩ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেননি। পরিষ্কার হয়ে যায় তৈমূর আলম খন্দকারই স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী। মুষড়ে যায় আইভী শিবির তথা স্থানীয় আওয়ামী লীগ। চিন্তার ভাজ তাদের কপালে। এবার শুরু হয় তৈমূরকে নিয়ে আইভী বলয়ের নেতাকর্মীদের নতুন আলোচনা। তারা প্রচার করে যেখানে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচনে যাবে না সেখানে তৈমূর আলম খন্দকার দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করছেন। তাকে দল বহিষ্কার করবে। তাছাড়া তৈমূর আলমকে ২০১১ সালের ৩০শে অক্টোবরের নির্বাচনের মতো আবারো তৈমূর বসে পড়বে। অথবা দল তাকে বসিয়ে দেবে। এমন আলোচনা যখন তুঙ্গে। তখন ২৫শে ডিসেম্বর তৈমূর আলম খন্দকারকে জেলা বিএনপির আহ্বায়কের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে এক নাম্বার যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবিকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়। ২৬শে ডিসেম্বর খবরটি ছড়িয়ে পড়লে বুঝে হোক আর না বুঝে হোক বিএনপির নেতাকর্মীরা হতাশ হন। তবে আইভী সমর্থিত বিএনপির নেতারা বেশী খুশি হন। এ ঘটনায় আইভী বলয়ের আওয়ামী লীগ নেতারা প্রচার করেন কি দরকার ছিল, এখন তো তৈমূর আলম জেলা বিএনপির পদ হারালেন। সামনে হয়তো দল থেকে বহিষ্কারও হবেন। আইভী সমর্থিতরা প্রহর গুনছেন তৈমূর আলমের বহিষ্কারাদেশ কখন আসে। তাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় ২৯শে ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে। কিন্তু অপেক্ষার পরিসমান্তি যে এমন হবে তারা কল্পনাও করতে পারেনি। বুঝতে পারা তো দূরের কথা। তৈমূর আলমকে বহিষ্কার তো ভিন্ন জগতের বার্তা। উল্টো তাকে দলীয়ভাবে সমর্থন দেয়া হয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওইদিন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামালের মোবাইলে ফোন করে জানিয়ে দেন, ‘তৈমূর সাহেব জনগণের দাবির মুখে, পরিবেশ পরিস্থিতিতে প্রার্থী হয়ে গেছেন। তিনি এখন জনতার প্রার্থী হয়েছেন। তিনি বিজয়ী হলে জনতার বিজয় হবে। তিনি ব্যর্থ হলে কিন্তু সরকার বলবে বিএনপির একজন নেতা স্বতন্ত্র নির্বাচন করে পরাজয় বরণ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে আপনারা বিবেক বিবেচনা করে যা ভালো মনে হয় করবেন। আপনাদের যার যার অবস্থান থেকে আপনারা আপনাদের কর্তব্য ঠিক করে নেবেন’।
মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্যের পর তৈমূর আলম খন্দকারের গণসংযোগে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ঢল নামে। দ্রুত পাল্টে যায় নির্বাচনী মাঠের দৃশ্যপট। এই খবরে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের মতো ঝাটকা লাগে আইভী বলয়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের শরীরে। হতবাক হন খোদ আইভী। পর্দার আড়ালে বিএনপির এমন চাল অপেক্ষা করছে যা তারা ঘুর্ণাক্ষরেও টের পাননি।
সূত্রমতে, আইভী সমর্থিত বিএনপি নেতাদেরও ঘুমে রেখেছে বিএনপির হাইকামান্ড। ফলে বিএনপির ভেতরের অবস্থা জানতে পারেনি আইভী শিবির। যদি কিছুটা হলেও টের পেতো তাহলে ২৬শে ডিসেম্বর যখন প্রকাশ হলো তৈমূরকে জেলা বিএনপির আহ্বায়কের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আসলে সেটা ছিল বিএনপির আরেক কৌশল। কারণ তৈমূর নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। দলকে তখন সময় দিতে পারবেন না। তাকে চাপমুক্ত রাখতে নির্বাচনকালীন সময়ে মনিরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। সোজা অংকটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে প্রতিপক্ষ শিবিরের।
এদিকে রোববার ২রা জানুয়ারি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জানানো হয় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিল থেকে তৈমূর আলম খন্দকারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই খবরটি ছড়িয়ে পড়লে আবারো আইভী শিবির স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে উচ্ছ্বাস শুরু হয়। তারা প্রচার করেন এবার তৈমূরের সব গেল। আহ্বায়কের পদ ও উপদেষ্টা পদ দুটিই সে হারালো।
কিন্তু বিএনপির একাধিক সূত্রমতে, এটা ছিল বিএনপির আরেকটি চাল। আর তা হলো যেহেতু বিএনপি বলে আসছে এই সরকারের আমলে তারা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিবে না সেহেতু তৈমূরের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নিলে তারা জাতীয় রাজনীতিতে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই কৌশলীভাবে তৈমূরকে দল থেকে বহিষ্কার না করে উপদেষ্টা পদ থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। নির্বাচনের পর তৈমূর আলম তার স্বপদে ফিরে যাবেন। শেষ সময়ে বিএনপির এমন নাটকীয়তায় আইভী তথা স্থানীয় আওয়ামী লীগ হতবাক। এমনটাই আলোচনা নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনে।
খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পদ থেকে তৈমূরকে প্রত্যাহার: নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী এডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিলের পদ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত রোববার বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষর করা এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়। তবে গতকাল বিষয়টি প্রকাশ পায়।
এর আগে জেলা বিএনপি’র আহ্বায়কের পদ থেকে তৈমূর আলমকে সরিয়ে জেলা বিএনপি’র এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবিকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়।
এদিকে প্রত্যাহারের বিষয়ে জানতে চাইলে সোমবার বিকালে তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ থেকে প্রত্যাহার বিষয়ে দল থেকে এখনো আমাকে কিছু জানায়নি। যদি এটা সত্য হয়ে থাকে, আলহামদুলিল্লাহ। আমি মনে করি বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটা সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আমাকে জনগণের জন্য মুক্ত করে দিয়েছেন। সুত্র-মানবজমিন