রায়হানের স্মৃতি আকড়ে ধরে জীবন কাটাতে চান তান্নি
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ মার্চ ২০২১, ৯:৪৬ অপরাহ্ণ
মো. রেজাউল হক ডালিম:
তিন কথার বাঁধনে জড়ানোর পর স্বামীর সবটুকু ঘিরেই তৈরি হয় স্ত্রীর পৃথিবী। সেই পৃথিবীর রাত-দিনজুড়ে লেপ্টে থাকে সুখানুভূতি- ভালোবাসাঘেরা মান-অভিমান। স্বপ্নীল আলোয় আলোকিত হয় স্ত্রীর প্রতিটি সময়ের পল-উপপল।
কিন্তু যাকে ঘিরে জীবনের সবকিছু- সেই স্বামীকে যদি কেড়ে নেয় একটি কালো রাত, তবে থমকে দাঁড়ায় একাকি বেঁচে থাকা স্ত্রীর ছন্দময় পৃথিবী। থেমে যায় সুখের পেন্ডুলাম। এমইন কষ্টময় সময় পার করছেন পুলিশি নির্যাতনে নিহত সিলেট নগরীর আখালিয়া নেহারিপাড়ার যুবক মো. রায়হান আহমদের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নির (২২)।
আজ ২ মার্চ (মঙ্গলবার) তান্নি ও রায়হানের বিয়ের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী। এই দিনে ভালো নেই বুকে জগদ্দল পাথর চেপে রাখা তান্নি। প্রতি মুহুর্তে মনে পড়ছে অকালে হারানো জীবনের স্বপ্নপুরুষকে, ক্ষণে ক্ষণে দুচোখ থেকে টপটপ ঝরছে ব্যাথার রুধির।
২০১৯ সালের ২ মার্চ সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার সুনাসার গ্রামের আজিজুর রহমানের মেয়ে তাহমিনা আক্তার তান্নির সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন রায়হান আহমদ। কিন্তু বিয়ের মাত্র ২০ মাসের মাথায় চিরতরে হারিয়ে ফেলবেন জীবনসঙ্গীকে, এমন কখনই ভাবেননি তান্নি।
বিয়ের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে ফোনে কথা হয় রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নির সঙ্গে। নিজের কষ্টানুভূতিগুলো ব্যক্ত করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ধরা গলায় কোনোমতে বলেন, রায়হান ছাড়া এ জীবন অন্ধকার। ভাবিনি- এত তাড়াতাড়ি তিনি চলে যাবেন। বাকিটা জীবন রায়হানের স্মৃতি আকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাই।
তিনি জানান, মনের অজান্তে আজও প্রতিরাতে জেগে থাকেন রায়হানের অপেক্ষায়। আজও কানে বাজে রায়হানের মমতাভরা ‘তান্নি’ ডাক। প্রতিরাতেই তাদের একমাত্র অবুঝ সন্তান আলফাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদেন রায়হানের স্ত্রী।
গত বছরের ১০ অক্টোবর বিকেলে নগরীর চৌকিদেখিস্থ নানার বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে দেখা করে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওয়ানা হন। এই ছিলো তান্নির সঙ্গে রায়হানের শেষ দেখা- শেষ কথা বলা। সেদিন আর বাড়ি ফিরতে পারেননি রায়হান। তার জন্যে অপেক্ষা করছিলো আকবর নামের এক ‘যমদূত’। ওই কালোরাতেই (১১ অক্টোবর রাতে)আকবর আর তার সহযোগিরা রায়হানকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ঠেলে দেয় পরপারের দোরগোড়ায়। মধ্যযুগীয় বর্বর নির্যাতনের ফলে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে রায়হান কয়েকঘণ্টা পর ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।
প্রথমে রায়হানকে ‘ছিনতাইকারী’ সাজানোর চেষ্টা করলেও পরিবারের দাবি, গণমাধ্যমে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও আন্দোলনের মুখে সে দাবি থেকে পুলিশ সরে আসে ।
পরে ১২ অক্টোবর রাত আড়াইটার দিকে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদি হয়ে সিলেট কোতোয়ালি থানায় নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন।
নিহত রায়হানের মরদেহে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন উঠে এসেছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে। এসব আঘাতের ৯৭টি ফোলা আঘাত ও ১৪টি ছিল গুরুতর জখমের চিহ্ন। এসব আঘাত লাঠি দ্বারাই করা হয়েছে। অসংখ্য আঘাতের কারণে হাইপোভলিউমিক শক ও নিউরোজেনিক শকে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে।
রায়হান আহমদ হত্যা মামলার তদন্তে সর্বশেষ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) আরও ৩০ কার্য দিবস সময় দিয়েছেন আদালত। রায়হান হত্যা মামলার তদন্তের জন্যে সময় বর্ধিত করার জন্যে গত ১০ ফেব্রুয়ারি সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আব্দুল মুমিনের আদালতে আবেদন করা হয়। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষে আদালত ৩০ কার্য দিবস বর্ধিত করেন। এই সময়ের মধ্যেই রায়হান হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দিতে হবে।
এদিকে, রায়হান হত্যার আলামত হার্ডডিস্ক নষ্ট করার মূলহোতা এসআই হাসান আলীকে গ্রেফতার করা হলেও সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমানের কোন খোঁজ এখনো মিলেনি। এই দু’জন মিলেই আলামত নষ্ট করে বলে পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তে উঠে আসে। সাংবাদিক নোমানকে আভিযোগপত্রে আসামি করা হবে কি-না তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে, রায়হান হত্যা মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
আলোচিত এই হত্যা মামলায় সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মূল অভিযুক্ত এসআই আকবরসহ ফাঁড়ির তৎকালীন টু-আইসি এসআই হাসান, এএসআই আশেক এলাহি, কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস, কনস্টেবল হারুনুর রশীদ ও নিহত রায়হানকে ছিনতাকারী হিসেবে অভিযোগকারী শেখ সাইদুর রহমান কারাগারে রয়েছেন।
সূত্র: সিলেট ভিউ