ব্রিটেনে ইসলামি শিক্ষা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ৩:১৪ অপরাহ্ণ
ড. শায়খ মাহমুদুল হাসান:
বারো বছর আগের কথা। ২০০৮ সাল। মেয়েদের ব্রিটেনে নিয়ে এসেছি। জাগতিক শিক্ষার ব্যবস্থা এখানে বিশ্বমানের। কিন্তু আধ্যাত্মিক শিক্ষার ব্যাপারে কী হবে! এ ভাবনা যখন চিন্তাকে গ্রাস করে রাখল তখন জামিয়াতুল কাওছার নামে একটি বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেলাম। তবে তা লন্ডন থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে, ল্যাংকাস্টার শহরে অবস্থিত।
আমরা কয়েক পরিবার প্রতিষ্ঠানটি ভিজিটের সিদ্ধান্ত নিলাম। ওই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে খুব ভোরে যাত্রা করে দুপুরের আগে সেখানে পৌঁছেও গেলাম।
প্রতিষ্ঠানটির আঙ্গিনায় পৌঁছে চক্ষু চড়কগাছ। বিস্মিত দৃষ্টিতে চতুর্দিকে তাকাচ্ছি। ঘুরে বেড়াচ্ছি। সবুজ আঙ্গিনায় চোখ জুড়িয়ে গেল। সুবিস্তৃত মাঠ, বনজ প্রকৃতি, ভিক্টোরিয়ান যুগের বিশাল অট্টালিকা, ঐতিহ্যের ছাপ ও প্রধান ফটকের কারুকাজ, সবকিছু মিলে মন আনন্দে ভরে গেল।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনের প্যাটার্নে নির্মিত এই ভবনটি কোনো একসময় ছিল রয়েল হসপিটাল। সময়ের বিবর্তনে এটি এখন ইউরোপের সর্ববৃহৎ বালিকা মাদ্রাসা ও মহিলা কলেজ। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের ছাত্রীরা এখানে এসে ইসলামের উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করে।
দারুল উলুম দেওবন্দের পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করে ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ডে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। ১৯৯৬ সালে এ প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। পশ্চিমা মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য আদর্শ নারী দাওয়াহ কর্মী তৈরিতে এটি অনন্য ভূমিকা পালন করছে। মুসলিম কোনো দেশেও এত সুন্দর ইসলামি প্রতিষ্ঠান পাওয়া প্রায় কঠিন।
ব্রিটেনে ইসলাম
বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অনন্য নজির ব্রিটেন। ২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারিতে ব্রিটেনে ছোট-বড় অসংখ্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের অবস্থানের তথ্য সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হলো মুসলিম ও ইসলামে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী।
সানডে এক্সপ্রেসের (আগস্ট ২০১৫) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্রিটেনে গির্জায় যাতায়াতকারীর চেয়ে মসজিদে আগমনকারীর সংখ্যা বেশি। ইসলামের সঙ্গে ব্রিটেনের যোগাযোগ সুপ্রাচীন। ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসার ((Geoffrey Chaucer) মুসলিম বিদ্বানদের কথা তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ (ঈধহঃবৎনঁৎু ঞধষব)-এ উল্লেখ করেছেন। ক্রসেডের পর রানী এলিজাবেথ প্রথম ওসমানী সুলতান মুরাদকে স্প্যানিশ রণতরী বহরের বিরুদ্ধে ব্রিটেনকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
জন নিলসন প্রথম ইংরেজ, যিনি পরে ১৫৮৩ সালে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ১৬৪৯ সালে ইংরেজিতে প্রথম কোরআন অনুবাদ করেন আলেক্সান্ডার রস। ব্রিটেনের সর্বপ্রথম কোন মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেলেও ব্রিটিশ আইনজ্ঞ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব উইলিয়াম হেনরি কুইলিয়ামের প্রতিষ্ঠিত ‘লিভারপুল মসজিদ’টি অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। ১৮৮৭ সালে তিনি এ মসজিদ ও ‘মদিনা হাউজ’ নামে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে ইসলাম বিস্তৃত হয়েছিল বলে জানা যায়। আর ১৮৭৩ সালের পর থেকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে তাদের অনেক কর্মচারী ভারতবর্ষ থেকে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাতে শুরু করেন। এভাবে ধীরে ধীরে ব্রিটেনে মুসলমানদের স্থায়ী বসবাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ মুসলিম ব্রিটেনে বাস করছেন, যা জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। মূলত দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগতরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
খণ্ডকালীন মাদ্রাসা
মুসলমানদের মধ্যে যারা নিজেদের বাসভূমি হিসেবে ব্রিটেনকে গ্রহণ করছেন, তারা মূলত দুটি সংস্কৃতি ও দুটি জগতের টানাপড়েনে বাস করেন। একটি হলো নিজেদের রেখে আসা দেশের কৃষ্টি এবং দ্বিতীয়টি হলো নতুন দেশের কৃষ্টি। এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনে তাদের অনেক ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হয়। বিশেষত প্রথমদিকে যারা ইমিগ্রেন্ট হয়ে এসেছিলেন, সেই মুসলিমদের সাংস্কৃতিক টানাপড়েন ছিল অতিমাত্রায়। ক্রমান্বয়ে মুসলমানরা নিজেদের মতো করে একটি আবহ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রথম প্রজন্ম যারা এ দেশকে নিজেদের ঠিকানা করেছিলেন, তারা নিজেদের সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। মূলধারার ইংলিশ স্কুলে তাদের সন্তানরা যাচ্ছে, কিন্তু তাদের খাবার, পোশাক ও নিজস্ব ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে স্কুলের পরিবেশ কোনোভাবে খাপ খাচ্ছিল না। মুসলমানরা এ বিষয়ে চিন্তিত ও তটস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তারা শহরে শহরে সংঘবদ্ধ হয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের চাহিদাগুলো পেশ করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে স্কুলগুলো কিছুটা হলেও মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের ধর্মীয় প্রয়োজন পূরণের পদক্ষেপ নিল। কিন্তু তা পুরো চাহিদার তুলনায় ছিল নিতান্ত অপ্রতুল। তখন মুসলমানরা নিজস্ব স্কুল ও মাদ্রাসা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করেন।
মাদ্রাসার সংখ্যা
বর্তমানে পুরো ইংল্যান্ডে প্রায় ১৫৬টি পূর্ণাঙ্গ মাদ্রাসা বা ইসলামিক স্কুল রয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি স্কুল সরকারি ফান্ডে পরিচালিত আর অন্যগুলো প্রাইভেট অর্থে নির্বাহ হয়। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা কিছুটা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। যেখানে মূলধারার স্কুলগুলো সম্পূর্ণ ফ্রি, সেখানে মুসলিম স্কুল বা মাদ্রাসায় পড়াতে হলে অভিভাবকদের উল্লেখযোগ্য টিউশন ফি ও অন্যান্য খরচ গুনতে হয়।
তবে এসব প্রতিষ্ঠান মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের মাত্র ০.৫ শতাংশ ধারণ করতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ‘অপেক্ষমাণ তালিকা’ রয়েছে। সাধারণত নতুন মুসলিম প্রজন্মের যারা বাধ্যতামূলক স্কুলে যাওয়ার বয়সে রয়েছে, তারা মূলধারার স্কুলে যায়। তাদের ইসলামি ভাবধারা শিক্ষা ও কোরআন শেখানোর জন্য মুসলিম কমিউনিটি শহরে শহরে কিছু খণ্ডকালীন মাদ্রাসা গড়ে তুলেছে।
এসব মাদ্রাসা মূলত মসজিদকেন্দ্রিক। সান্ধ্যকালীন বা সপ্তাহান্তে (শনি-রবি) এসব মাদ্রাসা পরিচালিত হয়। এ জাতীয় কয়েক হাজার মাদ্রাসা ব্রিটেন জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। এ ব্যবস্থাকে (Supplementary Islamic education) বলা হয়।
অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি শেখানোর জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে পরিচালনা করে। ইহুদিদের সিনাগগ, খ্রিস্টান, হিন্দু ও শিখদের মন্দিরে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে মুসলিম স্কুলগুলো খুবই কর্মচঞ্চল ও দ্রুত বিশ্বমানে উন্নীত হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভবিষ্যতের আলেম ও আলেমা তৈরির জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোকে সাধারণত ‘দারুল উলুম’ নামে অভিহিত করা হয়। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে এ নাম গৃহীত। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদ্রাসা ও স্কুল সমান্তরালে পরিচালিত হয়।
ব্রিটিশ ন্যাশনাল কারিকুলাম অনুযায়ী বাধ্যতামূলক আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত ছাত্রদের পড়াতে হবে। পাশাপাশি পাবলিক পরীক্ষা যেমন ও লেভেল এবং এ লেভেলে অংশ নিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হলেও ব্রিটিশ কর্র্তৃপক্ষ Ofsted-এর নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার আওতায় থাকে। শিক্ষার মান ও পরিবেশ যেন ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ডে থাকে সে বিষয়গুলো এখানে নিশ্চিত করতে হয়। এ-জাতীয় দারুল উলুম বা উচ্চতর কওমি মাদ্রাসা যেখানে দাওরা হাদিস পর্যন্ত পাঠদান করা হয়, তার সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য।
ফলাফলে চমক
কোনো কোনো দারুল উলুম বিভিন্ন শহরের অন্যান্য মূলধারার ইংলিশ স্কুলের চেয়ে পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে এবং সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সাধারণত প্রতিষ্ঠানগুলো আবাসিক। ছাত্রছাত্রীরা ইসলামি পরিবেশে শুধু জ্ঞানই অর্জন করে না বরং উন্নত জীবনধারা ও আধ্যাত্মিকতা চর্চা করার সুযোগ পায়।
মূলত সত্তর ও আশির দশক থেকে এই ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রগুলো প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। ১৯৭৮ সালে ইউরোপের তাবলিগি মারকাজ প্রতিষ্ঠিত হয় ডিইজবারি শহরে এবং পাশাপাশি ১৯৮০ সালে সেখানে চালু হয় মাদ্রাসাশিক্ষা কার্যক্রম।
‘জমিয়ত তালিমুল ইসলাম’ বা ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক এডুকেশন ((Institute of Islamic education) নামে এই কওমি মাদ্রাসাটি প্রাচীন একটি বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত। প্রচুর আলেম ইতিমধ্যে এখান থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন।
তবে ব্রিটেনের সর্বপ্রাচীন মাদ্রাসা হলো, ব্যরিতে প্রতিষ্ঠিত দারুল ব্যরি। ১৯৭৩ সালে শায়খুল হাদিস জাকারিয়া কান্দলভি (র.)-এর ছাত্র এবং ভারতের গুজরাটের শায়খ হজরত ইউসুফ মোতালা (রহ.) এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সূচনা করেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বড় বড় দারুল উলুম ও মাদ্রাসার গোড়াপত্তন করেন।
তার হাতেই ডিইজবারি মাদ্রাসা, দারুল উলুম কিডমিনিস্টার, জামিয়াতুল ইমাম মুহাম্মদ জাকারিয়া ব্রাডফোর্ড (মহিলা মাদ্রাসা), মাদ্রাসা মিসবাহুল উলুম ব্রার্ডফোর্ড, মার্কাজুল উলুম বাকবার্ন (বালক-বালিকা মাদ্রাসা), মাদ্রাসা আল-ইমাম মোহাম্মদ জাকারিয়া বল্টন, মাদ্রাসা আল-ইমাম মুহাম্মদ জাকারিয়া প্রেস্টন, আজহার অ্যাকাডেমি লন্ডন প্রমুখ খ্যাতিমান মাদ্রাসা স্থাপিত হয়।
৭৫ শতাংশ ইংরেজি ভাষাভাষী উলামা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে গড়ে উঠেছেন বলে ধারণা করা হয়। হজরত ইউসুফ মোতালা কওমি মাদ্রাসা বিস্তারে এবং ব্রিটেন জুড়ে দীন প্রচারে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ওপরে আলোচিত এসব প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ল্যাংকাস্টারে জামিয়াতুল কাওছার মহিলা মাদ্রাসা, জামিয়াতুল হুদা নটিংহ্যাম মহিলা মদ্রাসা, দারুল উলুম বার্মিংহাম জামিয়াতুল ইলমে ওয়াল হুদা ব্লাকবার্ন এবং লন্ডন দারুল উলুম ব্রিটেন ও বৃহত্তর ইউরোপে দীনের সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী খ্যাতিমান আলেম
লেখক ও গবেষক; খতিব এসেক্স জামে মসজিদ এবং সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়