সিলেটি নাদিয়া হোসেনকে নিয়ে গর্ব করে বৃটেন
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ জুলাই ২০১৬, ৭:২৫ পূর্বাহ্ণ
সুরমা নিউজঃ
মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যুক্তরাজ্যজুড়ে এক জনপ্রিয় নামে পরিণত হয়েছেন নাদিয়া হোসেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই নারীকে নিয়ে বৃটেন এখন গর্ব করে। সিলেটি এই কইন্যাকে নিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড়। বিভিন্ন নামকরা ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ কাহিনী রচনা করা হয়েছে তাকে নিয়ে। তিনিই রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্মদিনে কেক বানিয়েছেন রাণীর জন্য। এমন সম্মান পাওয়া খুব বড় ভাগ্যের ব্যাপার। শুধু ভাগ্যই নয়, সঙ্গে যোগ থাকতে হয় নিজের চেষ্টা। এটা প্রমাণ করে দিয়েছেন গত বছর ‘দ্য গ্রেট বৃটিশ বেক অফ’ প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন নাদিয়া হোসেন। তার প্রশংসায় লন্ডনের দ্য টাইমস ম্যাগাজিন প্রচ্ছদ কাহিনী ছেপেছে তাদের সর্বশেষ ইস্যুতে। প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে পূর্ণ পৃষ্ঠাজুড়ে তার হাস্যোজ্জ্বল ছবি। তার প্রশংসায় বলা হয়েছে, তিনি বলেন, আমি কখনো বলিনি আমি পারবো না। আমি কখনও মনে করিনি যে, হয়তো হবে। আমি কখনও বলি না, আমি মনে করি না আমি পারবো। আমি যেটা মনে করি তা হলো, আমি পারি। আমাকে পারতেই হবে। বেকঅফ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর শুধু বৃটেনেই নয়, সারা বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। এখন তার নামের আগে যুক্ত হয়েছে কলামনিস্ট, লেখিকা। কলাম লিখছেন দ্য টাইমস ম্যাগাজিন ও এসেন্সিয়াল ম্যাগাজিনে। প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইন র্যানডম হাউজ, হোডার চিলড্রেনস বুকস ও হারলেকুইনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। দ্য অন শো’তে নিয়মিত সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন। লুজ ওমেন নামের একটি টিভি শোতে তিনি প্যানেল অতিথি। নাদিয়া হোসেনের জন্ম বৃটেনের লুটনে ১৯৮৪ সালের ২৫শে ডিসেম্বর। তার স্বামীর নাম আবদুল হোসেন। তাদের রয়েছে তিনটি সন্তান। এর মধ্যে দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে। লুটনেই চ্যালনি হাইস্কুল ও লুটন সিক্সথ ফর্ম কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তার রয়েছে তিন বোন ও দুই ভাই। স্কুল পর্যায়েই তিনি রান্নার মৌলিক দক্ষতা অর্জনের বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। তার মা কখনও বেকিং করে খাবার রান্না করতেন না। তিনি সব সময় ওভেনে রান্না করতেন। নাদিয়া রেসিপি সম্পর্কে শিখেছেন নিজেই। বিভিন্ন বই পড়ে ও ইউটিউবে ভিডিও দেখে এসব শিক্ষা অর্জন করেছেন তিনি। গত বছর ৫ই আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় দ্য গ্রেট বৃটেন বেক অফ প্রতিযোগিতা। ওই সময়ে তিনি তার স্বামী, সন্তানদের নিয়ে লিডসে একজন পরিপূর্ণ গৃহিণী হিসেবে বসবাস করছিলেন। একপর্যায়ে তিনি তার স্বামীর উৎসাহে নাম লেখান দ্য গ্রেট বৃটিশ বেক অফ প্রতিযোগিতার ৬ নম্বর সিরিজে। সেখানে মাত্র তিন ঘণ্টায় তিনি তৈরি করেন ১৬টি আইস বান। এর মধ্যে দুই ঘণ্টায় তৈরি করেন পল হলিউডের একটি রেসিপি মিলে-ফিউলি। চার ঘণ্টায় তৈরি করেন বহু স্তর বিশিষ্ট ‘মাই বিগ ফ্যাট বৃটিশ ওয়েডিং কেক’। এ প্রতিযোগিতা টেলিভিশনের মাধ্যমে উপভোগ করেন এক কোটি ৫০ লাখেরও বেশি দর্শক। এটিই ছিল ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি দর্শক উপভোগ করা একটি চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। এতে তার উপস্থিতি, তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে ধ্যানধারণা ছিল তা পাল্টে যায়। রাতারাতি সামাজিক মিডিয়ায় তার অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে যায়। তার মুখের অভিব্যক্তি, তার সরলতা মানুষকে কাছে টেনে নেয়। এতে তার অনলাইন অনুসারীরা নিজেদের ‘নাদিয়াটোরস’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার প্রশংসা আসে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের পক্ষ থেকেও। ২০১৫ সালের বড়দিনে নাদিয়া হোসেন উপস্থিত হন বিবিসি ওয়ানের মাইকেল ম্যাকইনতিয়ারস বিগ ক্রিসমাস শোতে। এটি রেকর্ড করা হয় থিয়েটার রয়েলে। এছাড়া তিনি বিবিসি ওয়ানের দ্য ওয়ান শো’র নিয়মিত একজন প্রতিবেদকও। লুজ ওমেন শোতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে তিনি ঘোষণা করেন, রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৯০তম জন্মদিনের কেক বানানোর সম্মান অর্জন করেছেন। ওই কেকে থাকবে কমলার স্বাদ। থাকবে কমলা বাটার ক্রিম। নাদিয়া বলেন, যখন আমি রাণীর জন্য কেক বানানোর কথা বাচ্চাদের বললাম তারা বিস্ময়ে আমাকে বললো: এ কথা কাউকে বলো না। গোপন রেখো। আমি আমার মেয়েকে এ কথা জানালাম। সে আমাকে বললো: ও মেরি বেরি? তুমি মেরি বেরির জন্য প্রচুর কেক বানিয়েছো।
এখানেই নাদিয়া হোসেনের কীর্তির কথা শেষ নয়। তিনি দ্য টাইমস ম্যাগাজিনে সাপ্তাহিক কলাম লিখছেন। দ্য টাইমস পত্রিকার সাপ্তাহিক সংস্করণ দ্য টাইমস ম্যাগাজিন। এটি প্রকাশিত হয় প্রতি শনিবার। এছাড়া মাসিক ম্যাগাজিন এসেন্সিয়ালে তিনি কলাম লিখছেন। তার রেসিপি স্থান পেয়েছে বিবিসির গুড ফুড ম্যাগাজিনে। রান্না ও বেকিং রেসিপি নিয়ে তিনি প্রথম বই লিখবেন। তাই তার সেই বই প্রকাশের জন্য ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তার সঙ্গে চুক্তি করেছেন পেঙ্গুইন র্যানডম হাউজের বৃটিশ প্রকাশত মাইকেল জোসেফ। এছাড়া তিনি শিশুদের জন্য গল্প ও রেসিপি নিয়ে বই লিখছেন। এটি প্রকাশ করার কথা রয়েছে হুডার চিলড্রেনস বুকস নামের প্রকাশনা সংস্থা থেকে। হারলেকুইনের জন্য লিখছেন নারী বিষয়ক তিনটি ফিকশন উপন্যাস। আইটিভি লরেইন প্রতিযোগিতায় টম ফ্লেচারের পাশাপাশি তিনিও বিচারক হিসেবে স্থান পেয়েছিলেন এ বছর। এ প্রকল্প থেকে শিশুদের একজন নতুন লেখক নির্বাচন করা হয়।
ওদিকে হিজাব পরিধানের কারণে তাকে যে নানাভাবে হেনস্তা ও হয়রানির শিকার হতে হয় পথে ঘাটে সেই জমানো কষ্ট ও নীরব কান্না অনুযোগ ও অভিমান হিসেবে ঝরে পড়েছে তার কণ্ঠে। একইসঙ্গে তিনি পবিত্র ইসলাম ধর্মের অপব্যবহার বিষয়ে তার আতঙ্কের কথাও জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘প্রত্যেকটি হামলার পরে আমি মেঘ মাথায় নিয়ে দরজার বাইরে বেরিয়ে আসি।’ বৃটেনের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট নাদিয়ার ওই মন্তব্য ছেপেছে টাইম ম্যাগাজিনের বরাতে। সিলেটের এই লন্ডনি কইন্যার মর্যাদা কত উপরে উঠেছেন, সেটা পরিষ্কার পত্রিকাটির এই ফলাও করা কভারেজে। তার ইসলাম ভাবনা নিয়েই প্রতিবেদন, সঙ্গে কয়েকটি বড় আলোকচিত্রও ছাপা হয়েছে। নাদিয়া বলেন, ‘আমি যদি ট্রেনে কি বাসে থাকি তাহলে লোকে আমার থেকে দূরে সরে বসে। আর ভ্রমণকালে আমার সঙ্গে যদি কোনো বাক্স বা স্যুটকেস থাকে তাহলে কেউ কেউ সেদিকে সন্দেহভরা চোখে তাকাবেন, বাসের জন্য অপেক্ষমাণ আমার দিকে এটা-ওটা নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।’ নাদিয়া হোসেন আরো বলেন, ‘গত নভেম্বরে প্যারিসে যখন আইসিস উগ্রপন্থিরা হামলা চালালো তখন আমার ভাইকে অপদস্থ হতে হয়েছিল।’ কিন্তু নাদিয়া বৃটিশ সমাজের প্রতি আশা ছাড়েননি। কারণ তার কথায়, বৃটেন একটি সমন্বিত সমাজ। তাই যারা আমার প্রতি নেতিবাচক ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন তারা নিঃসন্দেহে সংখ্যালঘু।’
নাদিয়া দম্পতির বিয়ের বয়স ১১ বছরের, পরিবারের সম্মতিক্রমে বিয়ে হয়েছিল তাদের। তার স্বামীও অপমানের শিকার হয়ে থাকেন, আর সেটা করেন রক্ষণশীল মুসলিমরা, যারা তাদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি পছন্দ করেন না। তারা টিটকারি দিয়ে বলেন, স্ত্রীর ভরণপোষণ কি সে (স্বামী) দিতে পারে না? তাহলে স্ত্রীকে কেন কাজে নামিয়েছে? নাদিয়ার স্বামী একজন পুরুষ মানুষই নন। কিন্তু এসব কথা শুনে আমার স্বামী বিচলিত হন না। তার একটুও মন খারাপ হয় না। নাদিয়া আরো বলেন, ‘ আমার সংস্কৃতিতে এটা অনুমোদনযোগ্য নয় যে, স্বামী গৃহস্থালী কাজ করবেন। গত রাতে আমি বিছানায় শুয়ে টুইটে ব্যস্ত ছিলাম। আর সে সময় আমার স্বামী আমার পায়ের কাছে কাপড় চোপড় ইস্ত্রি করছিলেন। এই দৃশ্য যদি আমাদের কোনো জ্যেষ্ঠ আত্মীয় অবলোকন করতেন, তাহলে নির্ঘাত তার মৃত্যু ঘটতো!’
বৃটেনের এক কোটি ৩০ লাখ টিভি দর্শকের বাড়িতে বাড়িতে এক নামে যাকে সবাই চেনেন, তিনি বাংলাদেশি নাদিয়া, একথা লিখছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রতিবেদক অলিভিয়া ব্লেয়ার। তার কথায়, সব থেকে নামকরা বেকারের খেতাব কুড়ানোর পর থেকে নাদিয়া পত্রিকায় লিখছেন, কুকবুক বের করা নিয়ে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন, আর ঘন ঘন উপস্থিত হচ্ছেন টিভি টক শোতে।