সিলেটের নাগা মরিচের রাজত্ব বিশ্বজুড়ে
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০১৬, ৩:০২ অপরাহ্ণ
বিশেষ প্রতিনিধি:
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল এবং কমলগঞ্জের পাহাড়ি টিলায় উৎপাদিত নাগা মরিচ হাসি ফোটাচ্ছে চাষীদের মুখে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপক চাষ তাদের সাফল্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নানা জাতের লেবু আর মরিচ চাষ হচ্ছে একই সাথে একই বাগানে। পাশাপাশি এই দু’ফসলের চাষে লাভবান হচ্ছেন চাষীরা। এ দু’ উপজেলার উৎপাদিত “নাগা” মরিচের বাৎসরিক বিক্রয় মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। এমন তথ্য সংশ্লিষ্টদের। স্থানীয় ও দেশ বিদেশের ব্যাপক চাহিদার এ মরিচ ঝাল, ঘ্রাণ আর রং-এই তিন গুণেই আকৃষ্ট করে ভোজন রসিকদের। সিলেট অঞ্চলের ব্যাপক জনপ্রিয় “নাগা” মরিচের ঘ্রাণ আর সাতকরা কিংবা আদা লেবুর স্বাদে তৃপ্ত এ অঞ্চলের ভোজন রসিকরা। রন্ধন শিল্পের শৈল্পিকতার অন্যতম এ উপকরণ তিনটি-ই খাবারে ভাড়ায় রুচি। পরিবেশনে আনে বৈচিত্র্যতা। আর স্বাদে দেয় এক অন্যরকম তৃপ্তি। তাই ঐতিহ্যের এই চলিষ্ণু রেওয়াজ অনুযায়ী, সিলেটিদের খাবারের তালিকায় পছন্দের শীর্ষে এই তিন পদই।
পাহাড়ি এ অঞ্চলে নানা জাতের লেবুর মধ্যে সাতকরা আর আদা এ দু’জাতের লেবুই স্থান করে নিয়েছে স্বাদ ও ঘ্রাণের অনন্য গুণে। অনুরূপ এখানকার নানা জাতের মরিচের মধ্যে “নাগা” স্বাদের চাইতে তার যাদুময়ী ঘ্রাণ আর রং বিমোহিত করে ভোজন রসিকদের। নাগামরিচ শুধু ঝালমুড়ি, ভর্তা, চাটনি, শাক-সবজি কিংবা শুটকির তরকারিতে নয়, এখন নাগামরিচের আচারও ব্যাপক জনপ্রিয় হচ্ছে দিন দিন। দেশের নামি-দামি কোম্পানীগুলোও তৈরি করছে নাগামরিচের আচার, জেলি ও সস। দিন দিন যেমন বাড়ছে নাগা মরিচের চাহিদা। তেমনি স্থানীয়ভাবে বাড়ছে এর উৎপাদনও।
অল্প খরচে স্বল্প জায়গায় কম পরিশ্রমে অধিক লাভজন এ ফসল চাষে এখন ঝুঁকছেন স্থানীয় চাষীরা। স্থানীয় চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে নাগা মরিচের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি ধীরে ধীরে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তাই দেশ-বিদেশের চাহিদার যোগান দিতে স্থানীয় কৃষকরা এখন ব্যাপক পরিসরে চাষ করছেন ঝালের রাজা “নাগা” মরিচ। জেলার ৭টি উপজেলার পাহাড়ি টিলায় দিন দিন নতুন করে বিস্তৃত হচ্ছে নাগা মরিচের চাষ। সখের বশে বাড়ির আঙিনা আর ক্ষেতের আইলের চাষকৃত নাগা মরিচ এখন পাহাড়ি টিলার বিশাল এলাকাজুড়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হচ্ছে। জেলার কুলাউড়া, জুড়ী বড়লেখাসহ অনান্য উপজেলাতে কম-বেশি নাগা মরিচ চাষ হলেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপক পরিসরে চাষ হচ্ছে কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলে। কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের উত্তর-পশ্চিম পাশের (কমলগঞ্জ ইউনিয়নের ৪নং ওর্য়াড এলাকায়) পাহাড়ি এলাকায় ১৫-২০টি লেবু বাগানের সাথে চাষ হচ্ছে নাগা মরিচ। ওখানকার চাষী দেলওয়ার হোসেন, এনামুল হক, নাজমুল হক, হেলেনা আক্তার, দিলারা বেগম ও বালিগাঁও’র সানুর মিয়াসহ অনেকেই জানালেন, লেবু বাগানের সাথে তারা চাষ করছেন নাগা মরিচ।
প্রতিটি বাগানে ১ হাজার থেকে শুরু করে ১৫-২০ হাজার গাছও লাগানো হয়েছে। তারা জানালেন, লেবু গাছের গোড়া ঠাণ্ডা রাখতে লেবু গাছের গোড়ার পাশেই রোপণ করা হয় নাগা মরিচের গাছ। মরিচ গাছের পাতা ও ডাল-পালা রোদের আলো থেকে রক্ষা করে ঠাণ্ডা রাখে লেবু গাছকে। আর লেবু গাছের গোড়ায় দেওয়া সার, গোবর থেকে খাদ্য পায় মরিচ গাছ। তাই উভয় ফসলই একে অপরের উপকারী হয়ে ভালো ফলন দেয়। ফলে লেবুর পাশাপাশি বাড়তি আয় হচ্ছে নাগা মরিচ চাষ করে। শ্রীমঙ্গলের রাধানগরের কাজী জাহাঙ্গীর, তাহের মিয়া, বিক্রমপাশী জানান, তাদের এলাকায় কম- বেশি নাগা মরিচের চাষ হলেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপক পরিসরে শতাধিক লেবু বাগানের সাথে নাগা মরিচের চাষ করা হচ্ছে। শ্রীমঙ্গলের রাধানগর, বিষামণি, মহাজিরাবাদ, ডলুবাড়ি ও ইস্পাহানী চাষ হচ্ছে মরিচ। চাষীরা জানান, প্রাকৃতিক অবস্থা অনুকূলে থাকলে বছরে প্রতি একর জমিতে অন্যান্য ফসলের সঙ্গে উৎপাদিত নাগা মরিচ বিক্রি করে সব খরচ শেষে ৮০ হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকা আয় করা সম্ভব।
জেলার মধ্যে নাগা মরিচের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার শ্রীমঙ্গল। এই বাজারের মজই মার্কেটের নাগা মরিচের আড়তদার তুহিন মিয়া, আইনুল হক, জিতু মিয়া, কুদ্দুছ মিয়া জানান, লেবু বাজারের পর দুপুর থেকে বিক্রি চলে নাগা মরিচের। হাজার বা বস্তা হিসেবে তারা নাগা মরিচ ক্রয়-বিক্রয় করে থাকেন। তারা জানান, প্রতিদিন শ্রীমঙ্গল বাজারে ৩-৪ লক্ষ টাকার নাগা মরিচ বিক্রি হয়। এ অঞ্চলে উৎপাদিত নাগা মরিচের দেশ-বিদেশে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ক্রেতারা পাইকারি হিসেবে তাদের কাছ থেকে হাজার হাজার নাগা মরিচ দেশের নানা স্থানে পাঠানোসহ ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করে। তারা জানান, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে নাগা মরিচের। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাগা মরিচের পরিবার হলো সোলানেসি, জাত-ক্যাপসিকাম এবং প্রজাতি-ক্যাপসিকাম চাইনিজ। নাগা মরিচের ঝাল পৃথিবীর সব মরিচের চেয়ে অনেক বেশি বলে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঝাল মরিচ হিসেবে খ্যাত। ঝালের ইউনিট এসএইচইউ। স্কোভিল (ঝাল পরিমাপের মানদণ্ড) অনুযায়ী, নাগা মরিচের সাধারণ মান ১০ ++++। নাগা মরিচের ঝাল ১ লাখ থেকে ৩ লাখ এসএইচইউ পর্যন্ত। ২০০৭ সালে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বুকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঝাল ও সুগন্ধি মরিচের স্বীকৃত পায় নাগা মরিচ। মরিচ চাষীরা জানান, শীত ও গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমে নাগা মরিচ চাষাবাদ করা যায়।