বালাগঞ্জের মাইক্রোচালক বিষু হত্যা : শ্বাসরুদ্ধ করে লিঙ্গ কেটে নেয় ঘাতকরা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ আগস্ট ২০১৬, ৯:১৬ অপরাহ্ণ
শামীম আহমদ, হবিগঞ্জ থেকে ফিরে :
সিলেটের বালাগঞ্জের মাইক্রোচালক বিশ্বজিৎ দাস বিষু হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে সিআইডি পুলিশ। আলোচিত এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় মামলা দায়েরের পর সন্দেহভাজন হিসেবে বেশ কয়েক জনকে আটক করা হলেও ক্লু উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ ও ডিবি পুলিশের তদন্তে কোন অগ্রগতি না হওয়ায় পরর্তীতে মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়।
ঘটনার প্রায় ১৬ মাস পর আলোচিত এই হত্যাকান্ডের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ও মূল পরিকল্পনাকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এমন দাবী হবিগঞ্জ সিআইডি পুলিশের।
নিহত বিষুর পিতা মন্টু দাস একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মন্টু দাসের বাড়ী হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার রুপাপৈল গ্রামে। বেশ কয়েক বছর যাবৎ ব্যবসার সুবাদে তিনি সপরিবারে সিলেটের বালাগঞ্জ বাজারস্থ নবীনগরে বসবাস করছেন। বিষু হত্যাকান্ডের ঘটনায় প্রথমে হবিগঞ্জের শায়েস্থাগঞ্জ থানা পুলিশ মামলা নিতে অপারগাতা দেখিয়ে সিলেটের বালাগঞ্জ থানায় মামলা করার পরামর্শ দেয়। দুই থানার মধ্যে ঠেলাঠেলির পর অবশেষে ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে বিষুর পিতা বাদী হয়ে শায়েস্থাগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-০২।
থানায় মামলা দায়েরের পর কোন অগ্রগতি না হওয়ায় তিন মাস পর অর্থাৎ ২৭ জুলাই মামলাটি হবিগঞ্জ ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। ২৫ অক্টোবর ডিবি পুলিশ নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা এলাকা থেকে বিষুর ব্যবহৃত ছিনতাই হওয়া মাইক্রোবাসটি (সিলেট-ছ ১১-০৭২১) পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে। নোহা গাড়ী উদ্ধার ব্যতিত ডিবি পুলিশের তদন্তে আর কোন অগ্রগতি না হওয়ায় ৮ মাস পর অধিকতর তদন্তের জন্য মামলাটি হবিগঞ্জের সিআইডিতে (পুলিশের অপরাধ তদন্ত শাখা) হস্তান্তর করা হয়। সিআইডি পুলিশ চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে এ মামলার তদন্ত ভার গ্রহণ করে বিষুর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন সেটটির সুত্র ধরে হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। হবিগঞ্জের সিআইডি পুলিশের ইন্সপেক্টর আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে ৪ আগষ্ট ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থানার পাকুড়িয়া এলাকা থেকে রাসেল (২৫) নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া রাসেল হালুয়াঘাট থানার পাকুড়িয়া গ্রামের কায়েস মিয়ার ছেলে। ৫ আগষ্ট বিকাল ৩টায় হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিশাত সুলতানার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করে রাসেল। জবাবন্দিতে সে বিশ্বজিৎ দাস বিষু (২৫) হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়।
হবিগঞ্জ সিআইডি পুলিশের ইন্সপেক্টর ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন-বিষুর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি কেউ একজন ব্যবহার করছে এমনটি নিশ্চিত হওয়ার পর মোবাইল ট্যাকিং করে ঘাতক রাসলকে গ্রেফতার করা হয়।
ঘাতক রাসেলের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে আব্দুর রাজ্জাক বলেন-২০১৫ সালের ৫ এপ্রিল দিনের মধ্য ভাগে নিহত মাইক্রোচালক বিষু সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজার থেকে ভাড়ায় দু’জন যাত্রী নিয়ে ময়নসিংহের শম্ভুগঞ্জ এলাকায় যায়। রাত প্রায় ১১ টার দিকে যাত্রী নিয়ে সেখানে পৌছে। যাত্রীদের নামিয়ে ফেরার পথে শম্ভুগঞ্জ ব্রীজের নিকট ঘাতক রাসেল (সিআইডি পুলিশের হাতে আটক হওয়া) সহ ৬জন সিলেটে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর মাজার জিয়ারতের কথা বলে মাইক্রোবাসটি ৪ হাজার টাকায় ভাড়া নেয়। সিলেটে আসার পথে কিশোরগঞ্জ ও কটিয়াদি থানার মাঝামাঝি একটি নির্জন স্থানে প্রশ্রাব করার কথা বলে মাইক্রোবাসটি দাঁড় করায় রাসেল ও তার সহযোগিরা। গাড়ী থামানের পর ঘাতকরা কৌশলে বিষুকে গাড়ি থেকে নামিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা ও তার লিঙ্গ কেটে ফেলে। পরে বিষুর লাশটি গাড়ির সিটের পেছনে লুকিয়ে রেখে ঘাতকদের মধ্য থেকে একজন গাড়ীটি চালিয়ে হবিগঞ্জের শায়েস্থাগঞ্জের দিকে আসে। রাত তিনটার দিকে মাইক্রোবাসটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শায়েস্থাগঞ্জের দেউন্দি এলাকায় পৌঁছে। তখন ঘাতকরা লাশটি নির্জন স্থানে ফেলে দিয়ে গাড়ীটি ঘুরিয়ে নিয়ে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থানার পাকুড়িয়ায় চলে যায়। সেখানে গিয়ে পাকুড়িয়ায় ঘাতক রাসেলের এক সহযোগির শ্বশুড় বাড়িতে মাইক্রোবাসটি লুকিয়ে রাখে। আর বিষুর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি নিয়ে নেয় ঘাতক রাসেল। মাইক্রোবাসটি পাকুড়িয়ায় ১৫ দিন রাখার পর ঢাকার এক ব্যক্তির নিকট বিক্রি করে দেয় ঘাতকরা।
২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল ভোরে বিষুর মৃতদেহ অজ্ঞাত অবস্থায় উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠায় শায়েস্থাগঞ্জ থানার পুলিশ। ময়না তদন্ত শেষে অজ্ঞাত ও জাতি-বর্ণ পরিচয়হীন অবস্থায় লাশটি আংশিক ভাবে সমাহিত করে রাখা হয়। সন্ধ্যার দিকে বালাগঞ্জ থানার ওসি তরিকুল ইসলাম তালুকদার সায়েস্থাগঞ্জ থানা পুলিশের হাতে উদ্ধার অজ্ঞাত একটি যুবকের লাশের ছবি ফেইসবুকে দেখতে পান। ঐ দিন রাতে বিষুর পিতাসহ অন্যরা সেখানে গিয়ে ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করেন। পরে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে ৮এপ্রিল বিষুর লাশ বালাগঞ্জে এনে অন্তোষ্টিক্রীয়া সম্পন্ন করা হয়।
এই মামলায় মোবাইল কল লিষ্টের সুত্র ধরে সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। সন্দেহভাজন আটকদের মধ্যে গাড়ীর মালিকের এক শালা ও বালাগঞ্জের একজন মাইক্রোচালক ছিলেন। এর মধ্যে ওসমানীনগরের বাসিন্দা গাড়ীর মালিকের শালা নুর উদ্দিন এখনও জেল হাজতে রয়েছেন। মাইক্রোচালক আহমদ আলী উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসার পর অন্য আরেকটি মামলায় সে বর্তমানে হাজতে রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে গাড়ীর মালিকের শালা ও বালাগঞ্জের অপর মাইক্রোচালক বিষু হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে দৃশ্যমান কোন তথ্য আদায় করতে পারেনি পুলিশ।
এদিকে হতদরিদ্র বিষুর পিতাকে শান্তনা দিয়ে মামলাটির তদারকির দায়িত্ব নেন নোহা গাড়ীর মালিক সৌদি আরব প্রবাসী শফিকুল ইসলাম আরক। হবিগঞ্জ থেকে বিষুর লাশ নিয়ে আসা থেকে শুরু করে মামলা দায়েরসহ সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করেন তিনি। কিন্তু সন্দেহভাজন হিসেবে শালা আটক হওয়ার পরই বিপত্তিতে পড়েন গাড়ীর মালিক। এই সুযোগে বালাগঞ্জের মাইক্রেবাস চালক সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয়রা গাড়ীর মালিকের কাছে বড় অংকের টাকা দাবী করে বসে। দাবিকৃত টাকার মধ্যে কিছুটা দেয়া পর আবারও দাবী করা হয়। শেষ পর্যন্ত কোন উপায়ান্তর না দেখে বাধ্য হয়েই তিনি প্রবাসে চলে যান বলে তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন।
বিষুর পিতা মন্টু দাস কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন-‘আমার এক ছেলে এক মেয়ের মধ্যে বিষু বড় ছিল। একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছি। বয়স হয়ে গেছে বাকী জীবন কি ভাবে কাটাব ভেবে পাচ্ছিনা। অভাবের সংসার ঠিকমতো মামলার খোঁজ-খবর নিতেও পারছিনা। অপরাধী কেউ যেন ছাড় না পায় আমি তাদের বিচার দেখে মরতে চাই’।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হবিগঞ্জ সিআইডি পুলিশের ইন্সপেক্টও আব্দুর রাজ্জাক বলেন-ঘাতক স্বীকারোক্তি অনুযায়ী অন্যান্য আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। অতি শীঘ্রই তাদেরকে গ্রেফতার করা হবে।